×

জাতীয়

পুরো অঞ্চলে জঙ্গিবাদ ছড়াচ্ছে পাকিস্তান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৫০ এএম

পুরো অঞ্চলে জঙ্গিবাদ ছড়াচ্ছে পাকিস্তান

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (ফাইল ছবি)

২৬ নভেম্বর এই অঞ্চলের ইতিহাসে একটি ঘৃণ্যতম দিন। ২০০৮ সালের এই দিনে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-এ-তৈয়বা নামক এক চরমপন্থি জঙ্গি গ্রুপ ভারতের মুম্বাই নগরীর কয়েকটি হোটেলে আক্রমণ চালিয়ে ১৭০ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা এবং ৩০৪ জনকে মারাত্মক জখম করে। যাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ছাড়াও ছিলেন ব্রিটিশ, আমেরিকানসহ ১৬টি দেশের নাগরিক। এই ঘটনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই আক্রমণ পরিকল্পনাটির নীল নকশা প্রণয়ন করেছিল পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী, আইএসআই। পুরো অভিযানের জন্য অর্থের জোগান দেয় তারাই। সমস্ত পরিকল্পনা তদারকি করেন আইএসআইর মেজর ইকবাল। একই সময়ে দুটি ৫ তারকা হোটেল (তাজ মহল হোটেল, ওবেরি ট্রাইডেন্ট হোটেল) এবং আরো ৪টি স্থানে (কামা হাসপাতাল, লিওপোন্ড ক্যাফে, চাবাদ হাউস ও সিবাজি টারমিনাসে) আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের পর মুম্বাই পুলিশ তদন্ত করে পরের বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে যে অভিযোগপত্র দাখিল করে তাতে উঠে আসে আইএসআইর পরিকল্পনাক্রমে এবং অর্থায়নে মোট ৩৪ জন পাকিস্তানি জঙ্গি এই নৃশংস আক্রমণ চালায়। এদের মধ্যে ৯ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আজমল কাসাব, ইউসুফ আনসারি ও সাব্বির আহমেদ শেখ নামে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হয়। বাকিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, যাদের পাকিস্তান আশ্রয় দিচ্ছে বলে নিশ্চিত হয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দারা। এদের মধ্যে আজমল কাসাব ছিল একমাত্র জীবন্ত জঙ্গি যাকে হামলাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছিল। তার জবানবন্দি থেকে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। যাতে ছিল তার দলের অন্য সদস্যদের নাম, আইএসআইর ভূমিকা ইত্যাদি। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আপিলি রায় অনুযায়ী তার ফাঁসির নির্দেশ কার্যকর করা হয়। আনসারি এবং সাহাবুদ্দিন নামে যে দুজনকে সন্দেহভাজন হিসাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তারা আদালতে বেকসুর খালাস পায়। তদন্তে জানা যায়, মুম্বাইতে আক্রমণের জন্য আইএসআইর নির্দেশ এবং পরামর্শক্রমে ২০০৬ সাল থেকে পুরো এলাকা এবং টার্গেটগুলো জরিপ করার দায়িত্বে ছিলেন ডেভিড কোলমেন হেডলি নামক এক তৈয়বা সদস্য, যিনি পাকিস্তানি বংশোদ্ভ‚ত মার্কিন নাগরিক। এ অপরাধে আমেরিকান আদালত তাকে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড দণ্ডিত করেছে। মুম্বাই হামলার পৈশাচিক ঘটনা সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং বিশ্ব নেতারা পাকিস্তানের ভ‚মিকার তীব্র নিন্দা জানান। জাতিসংঘও এই ঘটনার নিন্দা করে। আক্রমণের ১৫ দিনের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদ লস্কর-ই-তৈয়বার প্রধান হাফিজ সাঈদ এবং তার সহঅপরাধীদের নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত করে। এই নির্মম জঙ্গি ঘটনার মূল খলনায়ক হাফিজ সাঈদ। তিনি যে পাকিস্তানে জামাই আদরে গত ১২ বছর ধরে লালিত হচ্ছে তা সমস্ত তথ্য-উপাত্ত থেকেই জানা যাচ্ছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে এক সাজানো বিচারের মাধ্যমে তাকে কারাদণ্ড দেয়া যে নেহায়েতই চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টাÑ তা জানতে বেশি দূর যাওয়ার দরকার হয় না। তিনি আদালতে আসতেন লিমুজিন গাড়ি দিয়ে, যে গাড়িটি পাকিস্তান সরকার তাকে দিয়েছে। মুম্বাই হামলার পর পাকিস্তান সরকার তাকে অঢেল অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করেছে বলেও অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই বোঝাই যায়, হাফিজের ‘লোক দেখানো’ সাজা বর্তমানে অবস্থা সামলানোর চেষ্টামাত্র। অদূর ভবিষ্যতে তাকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। হাফিজের ব্যাপারে সব তথ্য-উপাত্ত পাকিস্তানকে দিয়েছিল ভারত। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মুম্বাই হত্যাকাণ্ড বা তা ঘটানোর ষড়যন্ত্রের কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। যা হলে তার সর্বনিম্ন সাজা হতো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বরং তার বিরুদ্ধে জঙ্গিদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের অভিযোগ আনা হয়, যার জন্য তার সাজা হয় ১১ বছর। তাছাড়া তথাকথিত গ্রেপ্তারের পর হাফিজকে জেলের নামে সুসজ্জিত আশ্রয়ে রাখা হয়। আরেক জঙ্গি জাকিউর রহমান লাকভির বিরুদ্ধে দুর্বল অভিযোগনামা দায়ের করার কারণে সে খালাস পায় এবং খালাসের বিরুদ্ধে আর আপিল করা হয়নি। ফাইনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) আরোপিত ধূসর তালিকা থেকে পাকিস্তানের নাম কাটানোর পন্থা হিসেবেই এরকম ‘লোক দেখানো’ বিচার করা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। আগামী বছরের ফেব্রæয়ারিতে ফাইনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) পরবর্তী সভায় পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। যার পরিণতিতে পাকিস্তানের উপরে আর্থিক অবরোধ আরোপিত হতে পারে। সেই ভয়েই পাকিস্তান তড়িঘড়ি করে সাইদ হাফিজের বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে। এছাড়া পাকিস্তানের ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এফআইএ) জঙ্গিদের যে তালিকা প্রণয়ন করেছে, এফএটিএফর সন্তুষ্টির জন্য তাতে মুম্বাই আক্রমণকারী কারোরই নাম নেই। ২৬ নভেম্বরের ওই হামলা ভারতে ঘটলেও তা থেকে আমাদের শঙ্কিত হওয়ার, সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কয়েক বছর আগে ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাসের এক ক‚টনীতিক এ দেশের বেশ কিছু জঙ্গি, ধর্মান্ধকে নিয়ে দূতাবাসের ভেতরেই সভা করলে তা আমাদের দক্ষ গোয়েন্দাদের নজরে পড়ে যায়। এরপর সেই ক‚টনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে আমাদের পবিত্র ভ‚মি ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ২০০০ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে কথা বলায় পাকিস্তানের উপরাষ্ট্রদূত ইরফান রাজাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার পর দেশ না ছাড়ার জন্য বহু টালবাহানা করেন তিনি। পরে তাকেও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পাকিস্তান দূতাবাসের পাশ দিয়ে যে সড়কটি রয়েছে সেটির নামকরণ করা হয়েছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত তা সহ্য করতে না পেরে ২০০৮ সালে খোদ আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নামটি তুলে দেয়ার মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ আবদার করতে দ্বিধাবোধ করেননি। যেটি কিনা ১৯৬৪ সালের ভিয়েনা কনভেশনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ খেলাপ। পাকিস্তান যে ১৯৭১ সালে তাদের পরাজয়ের গøানি এখনো ভুলে যেতে পারছে না এগুলো তারই প্রমাণ। আরো প্রমাণ হলো যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হওয়ার পর পাকিস্তান পার্লামেন্টের ধৃষ্টতাপূর্ণ নিন্দা প্রস্তাব। এছাড়া ২০০০ সালের নির্বাচনের জন্য পাকিস্তান দূতাবাস বিএনপি-জামায়াতকে প্রচুর পয়সা দিয়েছিল, সে কথা আইএসআইর সে সময়ের প্রধান পাকিস্তানের আদালতে প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যে পাকিস্তানি হাত ছিল, সেটা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। ২১ আগস্ট গ্রেনেড আক্রমণে যেসব গ্রেনেড ব্যবহার করা হয় তা থেকে এটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সে আক্রমণেও পাকিস্তান সম্পৃক্ত ছিল। তদুপরি পাকিস্তানের কুখ্যাত জঙ্গি দাউদ ইব্রাহিম যে লন্ডনে তারেক জিয়ার সঙ্গে প্রায়ই বৈঠক করেন; তার সমর্থনেও কিন্তু শক্তিশালী তথ্য রয়েছে। তাছাড়া বিএনপি শাসন আমলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য যে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল, তাতেও পাকিস্তানের হাত ছিল। কয়েক বছর আগে ঢাকার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যে ধরনের জঙ্গি আক্রমণ হয়, তার সঙ্গে মুম্বাই আক্রমণের মিল থাকায় হলি আর্টিজান আক্রমণেও পাকিস্তানি আইএসআইর সম্পৃক্ততা খোঁজাটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। তাছাড়া পাকিস্তানি আইএসআই যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার ফিরে না যেতে পরামর্শ দিচ্ছে, তাদের বিভিন্ন অপরাধ কাজে উদ্বুদ্ধ করছে; তাও প্রমাণিত। পাকিস্তান পুরো অঞ্চলটিতে জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেখানে কর্মরত লস্কর-ই-তৈয়বা এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনকে ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা সাম্প্রতিক প্রকাশিত তার বইতে অকপটেই প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান সরকার ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছিল। যার কারণে লাদেনকে হত্যা করা হয় পাকিস্তানকে না জানিয়ে। কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে। এ কথা প্রমাণ করছে পাকিস্তান জঙ্গিদের আশ্রয় দেয়া একটি দেশ। পাকিস্তান কর্তৃক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রপ্তানির ব্যাপারে মার্কিন ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স এই মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে, সন্ত্রাসমূলক মৌলবাদ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্ষতিকর প্রভাব হয়ত ফেলবে না, কিন্তু এর ফলে ওই অঞ্চলের স্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যখন আফজল কাসাবের ফাঁসি হয়, তখন ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব জুরিস্টের অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার জন্য আমি দিল্লি গিয়েছিলাম। আমি কাসাবের ফাঁসির আদেশের পক্ষে সেদিন যে ভাষণ দিয়েছিলাম, তা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলোতে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল। একই সঙ্গে পাকিস্তানি প্রধান বিচারপতির অনুষ্ঠানে যোগদান না করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। পাকিস্তানি প্রধান বিচারপতির অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও তিনি শেষ পর্যন্ত যাননি।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App