×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১০:৩৯ পিএম

পারমিতার জগৎ

পারমিতা নামটি নিয়ে সবার আগ্রহের সীমা-পরিসীমা ছিলো না; বিরোধও কম ছিলো না। “মুসলমান মেয়ের নাম ‘পারমিতা’? এটা কী কথা! কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।” কিন্তু ও যখন আমাদের মহল্লায় প্রথম প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়িয়েছিলো কেরোলিনের ফ্রক পরে, তখন কতই আর বয়স তার, বড়জোর বারো-তেরো বছর, বা তারচেয়েও কম। পারমিতা হেঁটে গেলে ওর পেছনে মনে মনে ছুটে যেতো মহল্লার কিশোর-যুবা অনেকেই। অনেকেই তাকে আপন করে পেতে চাইতো। অস্বীকার করবো না, আমারও আগ্রহ ছিলো পারমিতার জন্য; আমিও চাইতাম, পারমিতা হেঁটে যেতে অন্তত একবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসুক, অন্তত একবার কুশল বিনিময় করুক আমার সাথে। কিন্তু পারমিতার সে সব বিষয়ে সামান্য আগ্রহও ছিলো না; সুন্দর একটা মেয়েকে যে মন দেয়া-নেয়া করতে হয়, সে জ্ঞানটাও ছিলো না পারমিতা নামের মেয়েটির। দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন পরই পারমিতার মেজ’পা মধুমিতা নতুন বউ হয়ে এসেছিলেন আমাদের মহল্লায়। মধুমিতা ভাবীকে আমরা সদ্যতরুণরা সবাই মিতাভাবী ডেকেই সুখী ছিলাম। কাছাকাছি সময়ে আরও ক’জন নতুনবউ আমাদের পড়শি-ভাবী হয়ে এসেছিলেন; কিন্তু মিতাভাবী আসার পর সবাই যেনো ম্লান হয়ে গেল। মিতাভাবীর স্বামী স্যাটেলমেন্ট বিভাগের ভূমিজরিপ কর্মী হিসেবে সদ্য যোগ দিয়েছিলেন ঢাকায়। মিতাভাবীকে বিয়ে করে সলিম ভাইয়ের যেনো মাটিতে পা পড়ছিলো না। অশিক্ষিত বাবা-মা’র বিএ পাশ ছেলের যতটা অহম থাকার কথা সলিম ভাইয়ের অহম তারচেয়ে কিছুটা বেশিই ছিলো এবং তা মিতাভাবীর মতো সুন্দরী বউয়ের জন্যই, তা আমরাও বুঝতে পারছিলাম। মিতাভাবীর ক’বছর আগে বউ হয়ে এসেছিলেন নিলোভাবী। নিলো ভাবীর বিয়ে হয়েছিলো সলিম ভাইয়ের বড়চাচার বড় ছেলে মাখন ভাইয়ের সাথে। নিলোভাবীর আসল নামটা আমার কোনদিনই মনে থাকেনি, তবে পাকিস্তানের যৌনাবেদনময়ী নায়িকা নিলোর সাথে কিছুটা মিলের কারণেই আমি তাকে নিলোভাবী ডাকতাম। আমার দেখাদেখি বন্ধুরা কেউ কেউ তাকে একই নামে ডাকতো। নিলোভাবী গ্রামের মেয়ে, লেখাপড়া খুব বেশি নয়। তার মধ্যে প্রবল সারল্য ছিলো। চোখে-মুখে আগ্রহ নিয়ে নিলোভাবী একদিন প্রশ্ন করলেন, “ছুডমিয়া আইয়ুব খান কী খায়, কী রকম টাট্টিতে যায়?” কী উত্তর দেবো তাকে, আমি হাসি। তিনি সিরিয়াস হয়ে বলেন, “ঠাট্টা না ছুডমিয়া, সত্যি আমার জানতে মন চায়!” এসব ছিলো তার প্রশ্ন। যখন তার প্রথম কন্যাটির জন্ম হলো, তখন আমি তাকে ভিন্নরূপে দেখলাম। নিলোভাবীর বুকে এতো দুধ, মেয়েটা খেয়ে শেষ করতে পারতো না; দুধের ভারে বুক টনটন করতো, তখন নিলোভাবীকে দেখতাম নিজের স্তন টিপে টিপে দুধ বের করে ফেলে দিচ্ছেন। তখন আমার বয়স এতোটা নয়, যে নিলোভাবীর বাস্তবতাটা বুঝতে পারি; নিলোভাবীও অবলীলায় আমার সামনেই বুকের কাপড় সরিয়ে দিতো; কিন্তু তার সুডৌল স্তনের টইটম্বুর রূপটি দেখে নায়িকা নিলোকে না পাবার ব্যথাটা বুকের মধ্যে টনটন করে উঠতো আমার। নিলোভাবী কি জানতো আমার গোপন কষ্টের খবর? না-কি আমাকে তার স্তনের সৌষ্ঠব দেখিয়ে গোপনে কাছে টানতে চাইতো? আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না; মাখন ভাইয়ের ছোট ভাই রতন ভাই, যিনি বয়সে সলিম ভাইয়ের ছোট, কিন্তু বিয়ে করে আনলেন তার আগেই। রতন ভাইয়ের বউ সোহাগভাবীও গাঁয়ের মেয়ে, ততটা আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু বেশ নাদুস-নুদুস। রূপবতী হিসেবে নিলোভাবীর সমকক্ষ না হলেও পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাবশত প্রতিদ্ব›দ্বী। আমি কার দিকে যাবো, কার ঘরে বসে ফিল্মের নায়ক-নায়িকার কথা আলাপ করবো, তা নিয়ে যখন দ্বিধায় পড়ে গেলাম, তখনই বউ হয়ে এলো মিতাভাবী। অবশ্য ততদিনে নিলোভাবী অনেকটাই চালু হয়ে গেছে। বিয়ের পর মিতাভাবী বাংলায় অনার্সে ভর্তি হলেন আনন্দমোহন কলেজে; শুনেছি মিতাভাবী ক্লাসে যাবার পর ক্লাসে ছাত্রউপস্থিতির হার বেড়ে গেল। কিন্তু মিতাভাবীর আর অনার্স কমপ্লিট করা হলো না; তার ডাগর চোখের বর্শায় বিদ্ধ হয়ে অনেকেই নাকি কুপোকাৎ। সলিম ভাই অগত্যা নিজের স্ত্রীকে বাড়িতে বন্দী করে ফেললেন। মিতাভাবী যেনো বড় ট্রামকার্ড আমার হাতে। তার জন্য আমার বুকে কেমন কেমন করতো; কিন্তু যেদিন বোনের বাড়িতে বেড়াতে এলো পারমিতা, সেদিন আর পারমিতাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই পারছিলাম না। অনেকের মতো আমিও নজর রাখতাম পারমিতার উপর। কিন্তু ওর সাথে আগবাড়িয়ে কিছু বলাটা শোভন মনে হয়নি। পারমিতা কখনো তার বোনের বড় দেবর, কখনো সেজো দেবরের হাত ধরে হাঁটতো বিকেলে; আমার মতো অনেকেরই হয়তো চোখ টাটাতো। গান গেয়ে, শিষ দিয়ে, কতোভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইতাম পারমিতার; কিন্তু ওর চোখ ফিরতোই না। ওর সাথে যে আমার মোটেই কথা হয়নি তা কিন্তু নয়; যে কোনো সময় কথা বলতে পারতাম, কখনো ব্যাডমিন্টন খেলতে ডেকে নিতাম, পারমিতা নির্দ্বিধায় খেলতো আমাদের সাথে; খেলতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে ওর সদ্য জেগে ওঠা বুক কেঁপে উঠতো, আর আমার অন্তর কাঁপিয়ে দিতো। ওর ডাগর চোখে তাকিয়ে আমি স্বপ্ন আঁকতাম, ও তার কিছুই জানতো না। হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম, পারমিতার আনাগোনা নেই; কোথায় গেল পারমিতা? পারমিতা বাড়ি ফিরে গিয়েছিলো। বালিকা পাখিটি যেনো সন্ধ্যায় ফিরেছে আপন কুলায়। ও চলে যাবার পর আমাদের মহল্লায় সবার চোখে-মুখে বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছিলো যেনো, শীতের সূর্য উঠছিলো প্রতিদিন, কিন্তু কুয়াশার আড়াল যেন কাটছিলোই না। এ ক’দিনে পারমিতা শুধু ছেলে-যুবাদের নয়, বরং আমাদের মহল্লার পায়ে চলা পথ, বৃক্ষ-লতাগুল্ম সবাইকে আপন করে নিয়েছিলো। ও যখন সকাল-বিকাল ফুরফুরে মেজাজে হেঁটে যেতো, তখন কেবল ছেলে-যুবারাই নয়, আন্দোলিত হতো লতাগুল্মও। মহল্লার প্রত্যেকের বিষাদ তো আমি খোঁজ নিতে যাইনি, কিন্তু পারমিতার খোঁজ আমি অবশ্যই নিতে গেছি। আমি আনন্দমোহন কলেজে তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, আর পারমিতা জামালপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী; মিতাভাবীর কাছে ওর সম্পর্কে জানতে চাওয়া শোভন হবে মনে হয়নি আমার। কী করা যায় দু’দিন অস্থিরতায় কাটলো। শেষ পর্যন্ত মাথায় এলো নিলোভাবীর নাম। বেশ কিছুদিন ধরে নিলোভাবীর সাথে আমার দহরম-মহরম কমে গিয়েছিলো। পারমিতার খোঁজ করতে নতুন করে নিলোভাবীর দ্বারস্থ হলাম। : কী গো ছুডমিয়া সূর্য আইজ উঠলো কুন দিকে? আইজকাল তো আপনের মুখটা দেখাই যায় না! : না গো নিলোরাণী, আপনার রূপের চমক তো হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়, যে চাইলেই ভুলে থাকা যায়। : বুঝি ছুডমিয়া, সবই বুঝতে পারি। মনে হয় আমি বাতিল হইয়া গেছি আপনের চোখে। দ্যাশ স্বাধীনের পর পাকিস্তানের নিলোর সাথে আমারেও পর কইরা দিছেন? : আপনি প্রতিদিনের সূর্যকিরণ, সন্ধ্যার আকাশে আবির, আপনাকে কি ভুলে থাকা যায়? : আমি গৈ-গেরামের অশিক্ষিত মেয়ে; আমারে এইসব কঠিন কথা কইয়া লাভ কী? আমি নিলোভাবীর কথার কোন উত্তর না দিয়ে নিজেকে তার কাছে সঁপে দিলাম, তার গলা জড়িয়ে ধরে সামান্য সোহাগ দিলাম, কিছুটা লাবণ্য নিলাম। নিলোভাবী আমার এতোদিন দূরে থাকার কথা ভুলে সহজেই আপন করে নিলেন আমায়। “মেকি চকচকে রূপ বেশিদিন থাকে না, তারচেয়ে প্রকৃতির সবুজ চিরকালীন” এ সব বলে নিলোভাবীকে আমি উস্কে দিলাম মিতাভাবীর বিরুদ্ধে। কার্যোদ্ধার হয়ে গেলো। নিলোভাবী দু’দিনেই সব তথ্য এনে দিলেন। পরদিন আমি আমার বন্ধু আমানকে নিয়ে জামালপুরের উদ্দেশে ট্রেনে চাপলাম। জামালপুর গিয়ে বকুলতলা খুঁজে পেতে সময় লাগলো না মোটেই; পারমিতার বাড়িও খুঁজে পাওয়া গেল। বাড়িতে গিয়ে কী বলে আলাপ করবো? এ প্রশ্নটা এতক্ষণে মাথায় এলো। বকুলতলার পাকা বেদীতে বসে দুই বন্ধু মিলে একটা সিগারেট ভাগাভাগি করে ফুঁকলাম। আমান আমার ওপর সামান্য উষ্মা প্রকাশ করে বললো, “তর কাণ্ডজ্ঞান কবে হইবো! কথা নাই বার্তা নাই একজনের বাড়িত গেলেই হইলো!” আমানের কথার কী উত্তর করবো বুঝতে পারলাম না; সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললাম, “চল আগে গিয়ে পরোটা-ডিম আর মিষ্টি খাই। মিষ্টি খেলে তোর কথাগুলো মিষ্টি হতে পারে।” আমার সাথে আমানও হাসলো। মোড়ের কাছেই একটা দোকানে দু’জন গিয়ে বসলাম। পরোটা-অমলেট আর মিষ্টি খেয়ে বেরুলাম। পারমিতাদের বাড়ির পাশে ছোট্ট আড়া। আমরা আড়ায় বসে থাকলাম পারমিতার অপেক্ষায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠলাম দু’জন, পারমিতার দেখা পেলাম না। অগত্যা দুপুরের দিকে বেরিয়ে এলাম। জামালপুরে আমাদের কাজ নেই কোনো। স্টেশন থেকে বেরুবার সময় জেনে এসেছিলাম, ফিরবার ট্রেন ‘ঝটিকা এক্সপ্রেস’ সন্ধ্যা ছ’টায়। কী করে কাটবে এতোটা সময়, দুঃশ্চিন্তায় পড়া গেল। আমাদের আগ্রহ-আকুলতার বার্তা পৌঁছলো না পারমিতার কানে। বাকি বেলাটুকুর কর্মহীনতার কথা ভেবে আবার অস্থিরতা শুরু হলো আমার। আমান মনে হয় কিছু বলতে চাইছিলো, কিন্তু বলতে পারছিলো না। আমি ওর মনের ভাব বুঝে প্রশ্ন করলাম- : কি-রে আমান কিছু কইবি? : কী আর কমু! সারাদিন করমুডা কী? : তুই-ই ক কী করা যায়? : আমার মাথায় অত বুদ্ধি খেলে! : আচ্ছা, ম্যাটিনি শো-তে একটা সিনেমা দেখলে হয় না? সিনেমা শেষ করে সোজা স্টেশনে চলে যাবো। আমান যেনো এই প্রস্তাবটাই শুনতে চাইছিলো; ওর চোখ-মুখ চকচক করে উঠলো। অগত্যা দু’জন হোটেলে খেয়ে ছবিঘরে ঢুকে গেলাম এবং ছবি শেষ করে স্টেশন হয়ে ট্রেনে ময়মনসিংহে পৌঁছলাম। পারমিতা ছাড়াই আমাদের মহল্লার জীবন কাটছিলো। সবার চোখ-মুখ থেকে বিষাদচিহ্নগুলো ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। দিন কেটে যাচ্ছিলো সবার সাথে আমারও। বছরে দু’একবার পারমিতা বেড়াতে এসেছে মেজ’পা মধুমিতাভাবীর কাছে, আবার ফিরেও গেছে। বারবারই দেখা হয়েছে ওর-আমার। পাশাপাশি বাসা হবার কারণে মিতাভাবীদের বাসায় কেউ একটু জোরে কথা বললেও আমাদের ঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। মিতাভাবির বড় দেবর করিম ওকে আদর করে ‘নিরু’ বলে ডাকে, আর সেজো দেবর মাসুম ডাকে ‘পারু’ নামে। মেজো দেবর সাদামাটা, সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। হয়তো করিমের হাত ধরে বেরুচ্ছে পারমিতা, পথেই দেখা হয়ে গেল আমার সাথে, করিম ভাই আমাকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, “কী রে সবুজ, তোর নাট্যচর্চা চলছে কেমন?” আমি হেসে উত্তর করলাম, “ভালো।” আড়চোখে একবার পারমিতাকে দেখে নিলাম। পারমিতা মিষ্টি হেসে আমায় প্রশ্ন করলো, “এখন কী নাটক করছেন সবুজ ভাই?” আমি “এইতো” বলে পাশকেটে গেলাম। করিম ভাই বয়সে আমার বেশ ক’বছরের বড়, তার সামনে বেশি কী আর বলতে পারতাম? অন্যদিন হয়তো বেরুচ্ছিলো মাসুমের সাথে, অনিবার্যভাবেই পথে আমার সাথে দেখা। মাসুম আমার খেলার সাথী, ওর সাথে রস করা যায়; কিন্তু সমস্যা হলো, শিশুকাল থেকেই মাসুম কানে একটু কম শোনে। আমি রস করে বললাম, “স্বজনকে বিকশিত হবার সুযোগ স্বজনেরই করে দিতে হয়।”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App