×

সাময়িকী

চেনা শহরে অচেনা একজন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১০:১৩ পিএম

চেনা শহরে অচেনা একজন

গলাব্যথা, কাশি ও জ্বরের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালের বিশেষ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে নিয়ামত। আশপাশের বিভিন্ন বেডেও আছে তার মতো একই উপসর্গের বিভিন্ন বয়সের রোগী। প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না তার। হাসপাতালকে সব সময় ভয় পায় সে। কয়েকদিন ধরে গলাব্যথার পাশাপাশি কাশি ছিল। গতকাল শরীরে জ্বর আসায় বেশ ভয় পেয়ে গেছে নিয়ামত। এসবই করোনা ভাইরাসের উপসর্গ। চারদিকে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে করোনা মহামারি। সাধারণ সর্দি কাশি জ্বর নিয়ে এদেশের মানুষ কাজকর্ম করে বেড়ায়। তেমন পাত্তা দেয় না। এটা একটা মামুলি অসুস্থতা মনে করে। এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তবে এবারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথমে চীন দেশে শুরু হয়ে এখন এই রোগটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। সর্দি কাশি জ্বর দিয়ে শুরু হলেও এক পর্যায়ে রোগীর ফুসফুস আক্রান্ত হয় তখন শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অবস্থা জটিল হলে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। এক সময় রোগী মৃত্যুবরণ করে। পত্রপত্রিকা পড়ে টিভিতে দেখে এসব জেনেছে নিয়ামত। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবীজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চীন ছাড়িয়ে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ভয়ঙ্কর মহামারি, বাংলাদেশেও ভয়াল থাবা দিয়েছে। এখানেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন অনেকে। আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। ঢাকার পর নারায়ণগঞ্জে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। অফিস আদালত বন্ধ হয়ে গেছে আরো আগে। নিয়ামত যে গার্মেন্টসে ফ্লোর ইনচার্জ হিসেবে চাকরি করে সেটা প্রথম কিছুদিন চললেও নারায়ণগঞ্জ শহরকে লকডাউন ঘোষণা করার পর বন্ধ হয়ে গেছে। কবে আবার চালু হবে, জানে না কেউ। এখানে এই অবরুদ্ধ শহরে শুধু শুধু বসে থেকে লাভ নেই। তার চেয়ে বাড়ি চলে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সরকার সব বাস ট্রেন লঞ্চ বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তারপরও মানুষ যে যেভাবে পারছে ছুটে পালাতে চাইছে এই শহর থেকে। এখানে থাকলে প্রাণঘাতী এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নব্বই ভাগ, সবাই বলছে। কিন্তু হঠাৎ করে গলাব্যথা, কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় নিজের মেসে শুয়ে কাটিয়েছে একটি দিন। মেসের প্রায় সবাই বাড়ি চলে গেলেও কয়েকজন এখনও যেতে পারেনি। নিয়ামত তার গলাব্যথা, কাশি ও জ্বরের বিষয়টি সাথের কাউকে না জানালেও এক সময় নিজের কাছেই ভয় লাগতে শুরু করে। তার মধ্যে যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তার সবই করোনার প্রকাশ। এই অবস্থায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইলেও অবস্থা আরো সংক্রটাপন্ন হলে কোথায় যাবে, এ রোগের চিকিৎসা কোথায় করাবে ইত্যাদি বিষয় ভাবতে ভাবতে মহল্লার ফার্মেসিতে গিয়ে পল্লী চিকিৎসক নুরুদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করে। দেখেশুনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছুটা উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে নুরুদ্দিন পরামর্শ দেয়, ‘ভাইরে, অন্য সময় হইলে আমি সাধারণ সর্দি কাশি গলার ব্যথার চিকিৎসা হিসেবে যে ওষুধপত্রের কথা কইতাম এখনও সেইটা কইতে পারি। কিন্তু এখন অবস্থা অন্যরকম। একই সিমটম নিয়া অনেক মানুষ মরতাছে দেশে-বিদেশে। কে করোনা ভাইরাস রোগে আক্রান্ত কে আক্রান্ত না, এইডা টেস্ট না করাইলে নিশ্চিত হওয়া যাইবো না। আমার ওপর ভরসা না কইরা নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালে গিয়ে সেখানকার ডাক্তার দেখান, পারলে ঢাকায় যান, সেইখানে আরো বড় বড় ডাক্তার আছে। সময থাকতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন-’ নুরুদ্দিনের একটানা কথাগুলো শুনতে শুনতে নিয়ামতের মাথাটা ঘুরে ওঠে। নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালে যাওয়ার পর যদি ডাক্তাররা তাকে সেখানে ভর্তি হতে বলে তাহলে কী হবে- ভাবতে ভাবতে ফার্মেসি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটে সে। শারীরিক অসুস্থতার কথা এখন গ্রামের বাড়িতে মাকে জানালে দুশ্চিন্তায় অস্থির হবে, তার শরীর খারাপ করবে। অনেক ভেবেচিন্তে নিয়ামত নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেক মানুষ ঢুকছে, বেরোচ্ছে। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক, দুশ্চিন্তার ছাপ। গোটা নারায়ণগঞ্জ জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করেছে প্রশাসন। সবাই এ নিয়ে আলোচনা, গবেষণা করছে। এখন কোথায় যাবে সে, কী করবে, মেসে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকবে নাকি হাসপাতালে ঢুকে ডাক্তার দেখাবে- সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে চট করে। এক সময় কী মনে করে মনে অনেক সাহস জড়ো করে গেট পেরিয়ে হাসপাতালে ঢুকে পড়ে। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার গম্ভীর মুখে জানায়, ‘আপনাকে এখনই আইসোলেশনে পাঠাতে হবে। লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না। আপনার সাথে কেউ কি এসেছে, বাসা কোথায়? আত্মীয়-স্বজনরা জানে আপনার অসুস্থতার কথা?’ ডাক্তারের পর পর এতো প্রশ্নের তোড়ে আরো ঘাবড়ে যায় নিয়ামত। ‘আইসোলেশন; মানে কী?’ আতঙ্কিত কণ্ঠে জানতে চায় সে। নিয়ামতের মধ্যে এতো দিন যে হাসপাতালভীতি ছিল, আজ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে। বাস্তবতা তাকে আজ সেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। এটাকে এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয় তার। হাসপাতালের অন্য সব ওয়ার্ড থেকে বেশ দূরে আলাদা একটি বিল্ডিংয়ে একটা ওয়ার্ডে ঠাঁই হয় নিয়ামতের। ঢোকার সময় বাইরে দেয়ালে লাগানো সাইনবোর্ডে ‘করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড’ লেখা দেখেছে সে। এখানে যারা বিভিন্ন বেডে শুয়ে কিংবা বসে রয়েছে তাদের সবারই একই উপসর্গ। তবে লক্ষণ দেখে অনেকটা সন্দেহ করে আপাতত অন্য রোগীদের চেয়ে দূরে বিচ্ছিন্ন করে নিরাপদ রাখার জন্য এই আইসোলেশন ব্যবস্থা। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন নার্স এসে নিয়ামতের রক্ত ও নমুনা নিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যাবে সে সত্যি সত্যি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কিনা। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে দু-একদিন। কারণ করোনা রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত। প্রচুর রোগী আসায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে ডাক্তার-নার্স সবাইকে। আইসোলেশনে তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন রোগীর অবস্থা রাতে বেশ খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য উত্তরার একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। চোখের সামনে এতো সব দেখতে দেখতে ভয়ে নিয়ামতের শরীরের রক্ত চলাচল যেন থেমে যায়। সকাল হতে হতে হয়তো তার অবস্থাও তেমন হবে। এখনই তার হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। তার শরীর থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নমুনা নিয়ে গেছে, এর ফলাফল জানতে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত ফলাফলে কী আসে এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ, গলাব্যথা জ্বর সর্দি কাশি হলেই সবাই যে করোনা আক্রান্ত, তা কিন্তু নয়। নিয়ামতের কপালে কী রয়েছে আল্লাহ জানেন। যদি তার সত্যি সত্যি করোনা ভাইরাস ধরা পড়েÑ তখন কী হবে! ভাবতে থাকে নিয়ামত। এখান থেকে বড় কোনো হাসপাতালে আর যেতে চায় না সে। কপালে যা-ই থাকুক না কেন, এখান থেকে পালাতে হবেÑ মনে মনে একটা চরম সিদ্ধান্ত নেয় নিয়ামত। আইসোলেশন ওয়ার্ডে যাদের রাখা হয়েছে তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গেটের কাছে কয়েকজন পুলিশও রয়েছে। এই কড়া পাহারার মধ্যে ফাঁকফোকর তো থাকবেই, সেই সুযোগটা নিতে হবে। এক সময় সুযোগ পেয়েও যায় নিয়ামত। হাসপাতালের স্টাফ এবং পুলিশ সবাই ভয়ে ভয়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। কারণ এখানে ডিউটি করতে গিয়ে করোনা ভাইরাসের জীবাণু তাদের শরীরে সংক্রমণ হতে পারে। তাই তারা অনেকটা দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে। নিয়ামত হেঁটে সামনে গিয়ে অবস্থাটা দেখে এসেছে। ঢিলেঢালা পাহারার সুযোগটা নিয়ে সন্তর্পণে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে নিয়ামত। মুখে মাস্ক এবং হাতে গøাভস পরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতরের অসুস্থতাকে আড়াল করে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো পথ চলতে থাকে। কেউ তাকে দেখে বুঝতে পারে না যে একজন আতঙ্কিত রোগী হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছে। কিছুদূর হাঁটার পর বেশ ক্লান্তিবোধ করতে থাকে নিয়ামত। রাস্তায় গাড়ি চলাচল খুব বেশি একটা নেই। বেশ ফাঁকা রাস্তাÑ যা সচরাচর দেখা যায় না। চারপাশের পৃথিবী হঠাৎ করে অনেক বদলে গেছে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই টের পায় নিয়ামত। অচেনা এক ভাইরাস পৃথিবী জুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সবাই করোনা আতঙ্কে তটস্থ। জনমনে হঠাৎ করেই দারুণ ভীতির সঞ্চার হয়েছে। মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে অফিস আদালত, কলকারখানা, মার্কেট, হাটবাজার, যানবাহন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সবখানে। জনসমাগম থেকে করোনা রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। যে কারণে সরকার সব কিছু ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। রাস্তায় চোখে মুখে অনেক আতঙ্ক, সন্দেহ, অবিশ্বাস আর চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ চলাফেরা করছে। পথে-ঘাটে যারা চলাচল করছে তারা কেউ সহজে অন্যের কাছে ঘেষতে চাইছে না। যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সবকিছুই তার কাছে কেমন অচেনা, নতুন মনে হয়। চিরচেনা জনবহুল দারুণ ব্যস্ত শহরটি কারো অভিশাপে যেন জনমানবহীন, স্থবির, অদ্ভুত শান্ত নীরব সুনসান হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে কোনো মানুষজনের চলাচল, আনাগোনা নেই। রিকশা, সাইকেল, হোন্ডা হঠাৎ হঠাৎ দু’একটা দেখা গেলেও তা আবার পরক্ষণেই চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। শহরের অচেনা নতুন রূপ দেখে নিয়ামতের মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। শহরের ভিন্ন এক অচেনা রূপ দেখতে দেখতে নিয়ামতের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বিরান জনমানবহীন প্রায় যানবাহনমুক্ত নীরব সুনসান শহরকে দেখে কেমন যেন মায়া হয় নিয়ামতের। ব্যস্ত এই শহরের লক্ষ লক্ষ মানুষের পদচারণায় মুখরিত চিরায়ত রূপের বদলে সম্পূর্ণ অচেনা নতুন এই রূপে দেখবে- কোনোদিন ভাবেনি সে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App