×

সাময়িকী

একটি যুদ্ধের দলিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১০:২৬ পিএম

একটি যুদ্ধের দলিল

‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’। লিখেছেন যুদ্ধের অসহনীয় কাহিনী, ভাইবোনের করুণ মৃত্যু স্মৃতির ভার বহন করা এক জীবন্ত, দগ্ধ-পোড়া মানুষ শৈবাল চৌধূরী। যিনি পাকিস্তানি হায়েনাদের কারণে, যুদ্ধের কারণে দেশের অনেক পরিবারকে নিঃশেষ হতে দেখেছেন। দেখেছেন নির্বংশ হয়ে যেতে। আমরা মনে করি, তিনি নিজেই মুক্তিযুদ্ধের একটা দলিল। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র এবং একই সঙ্গে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রেরও একজন বোধিবৃক্ষ শৈবাল চৌধূরী। তিনি লিখেছেন দেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের ইতিহাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য এবং নির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং জহির রায়হান। স্টপ জেনোসাইড বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। জহির রায়হান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এই তথ্যচিত্রটি তৈরি করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দিনকাল প্রভৃতি এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এই তথ্যচিত্রটি প্রথম প্রদর্শনী হয় এক অজ্ঞাত স্থানে। যেখানে ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে ‘স্টপ জেনোসাইড’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নির্মিত তথ্যচিত্রগুলোর মধ্যে শিল্প ও গুণগত সাফল্যের দিক থেকে এই স্টপ জেনোসাইডকেই শীর্ষে স্থান দেয়া হয়। প্রামাণ্যচিত্রটি শুরু হয় মহামতি লেনিনের বাণী দিয়ে। শুরুতে দেখা যায়- গ্রামীণ এক কিশোরী ঢেঁকিতে ধান ভানছে। গ্রাম্য কিশোরীর মনে কোনো কষ্ট, যন্ত্রণা, উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা নেই। যার মুখে সরল হাসি লেগে আছে। কিশোরীটি ধান ভেনে চলেছে। ধীরে ধীরে দৃশ্য পরিবর্তন শৈবাল চৌধূরী জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড নিয়ে তার সাবলীল, সুন্দর ও সরল ভাষায় বলেন, জহির রায়হানের প্রজ্ঞা, সাহস, সততা এবং দেশপ্রেম যেমন স্টপ জেনোসাইডকে এক ধ্রুপদী প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে পরিণত করেছে, তেমনি তুলে ধরেছেন আমাদের অনেক রক্তের, অনেক কান্নার, অনেক সম্ভ্রমের, অনেক সংগ্রামের এবং আমাদের সর্বকালের অহঙ্কারের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের দরবারে। ...স্টপ জেনোসাইড যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী চলচ্চিত্রের ভাণ্ডারে একটি সার্থক প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের দলিল। দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র নিয়ে শৈবাল চৌধূরী বিরামহীনভাবে কাজ করছেন। শৈবাল চৌধূরীর ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ গ্রন্থটিতে এ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে যত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার সবই তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন বেশ মুন্সীয়ানার সঙ্গে। এ গ্রন্থে আছে- জীবন থেকে নেয়া, স্টপ জেনোসাইড, যা নিয়ে আমি উপরে সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু বলেছি। আছে- নাইন মানথস টু ফ্রিডম, মেঘের অনেক রঙ, আগুনের পরশমণি, হাঙর নদী গ্রেনেড, ইতিহাসকন্যা, জয়যাত্রা, রাবেয়া, ১৯৭১, গুণ্ডে, যুদ্ধশিশু, ভুবন মাঝি ও রিনা ব্রাউনসহ অসংখ্য চলচ্চিত্র। আমরা শুধু হাঙার নদী গ্রেনেড নিয়ে কিছু বলবো এবং আমাদের এ লেখার ইতি টানব। হাঙর নদী গ্রেনেডের পরিচালক ও চিত্রনাট্য : চাষী নজরুল ইসলাম। কাহিনী লিখেছেন কথাশিল্পী সেলিনা হেসেন। কাহিনী অনেকটা এ রকম- গ্রামের দুরন্ত কিশোরী বুড়ির (সুচরিতা) অল্প বয়সে বিয়ে হয় তার থেকে দ্বিগুণ বয়সের গফুরের (সোহেল রানা) সাথে। গফুরের আগের ঘরের দুই সন্তান, সলিম আর কলিম। দুজনকেই বুড়ি খুব ভালোবাসে। তারপরও সে তার নিজের সন্তান চায়। জন্ম হয় তার বুড়ির নিজের সন্তান রইসের। কিন্তু অনেক সাধনার সন্তান রইস হয় বাক-প্রতিবন্ধী। ইতোমধ্যে গফুর মারা যায়। বড় ছেলে সলিমের বিয়ে হয়। ঘরে আসে নতুন বউ রমিজা। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয় যুদ্ধ। সলিম চলে যায় যুদ্ধে। বাড়িতে রেখে যায় কলিমকে মায়ের দেখাশুনার জন্য। পাকিস্তানিরা কলিমকে ধরে নিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেয়ার জন্য তাকে অনেক মারধর করে। একপর্যায়ে তারা কলিমকে মায়ের সামনে গুলি করে হত্যা করে এবং সুচরিতা মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে তার নিজের সন্তানকে তুলে দেয় পাক বাহিনীর কাছে। মুক্তিযুদ্ধের এ ঘটনা বড়ই নির্মম। হাঙর নদী গ্রেনেড নিয়ে শৈবাল চৌধূরী তার বইয়ে লেখেন- হাঙর নদী গ্রেনেড এদেশের একটি জননন্দিত উপন্যাস। এই উপন্যাস নিয়ে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের বিখ্যাত কারিগর সত্যজিৎ রায় ছবি করার কথা ভেবেছিলেন। ১৯৭৫ পরবর্তী পরিবেশের কারণে তিনি আর অগ্রবতী হননি বলে সেলিনা হোসেনের এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়।... এক গ্রাম্য মা তার নিজের প্রতিবন্ধী ছেলেকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিয়ে তার পরিবর্তে একজন মুক্তিসেনাকে রক্ষা করার ঘটনা এই উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। এর প্রেক্ষাপট হিসেবে এসেছে বাংলার একটি সুখী-সুন্দর গ্রামের প্রাত্যহিকতা। যে গ্রামটি বিধ্বস্ত হয় ১৯৭১ সালের যুদ্ধে। চমৎকার ডিটেইলস আছে সেলিনা হোসেনের এ উপন্যাসে। পরিচালকও সেসব ডিটেইলস তুলে ধরেছেন তার ছবিতে বেশ সুন্দরভাবে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ চলচ্চিত্রে সুচরিতা ও সোহেল রানা ছাড়া আরো আছেন- অরুণা বিশ্বাস, অন্তরা, ইমরান, দোদুল, আশিক, রাজিব, শওকত আকবর, শর্মিলী আহমেদ, মিজু আহমেদ, নাসির খান, চাষী নজরুল ইসলাম। এ ছবিটির চিত্রগ্রাহক : জেড এইচ পিন্টু সুরকার, শেখ সাদী খান, সম্পাদক : সৈয়দ মুরাদ। হাঙর নদী গ্রেনেড ছবিতে সুচরিতা রাষ্ট্রীয় সম্মান অর্জন করেন। শৈবাল চৌধূরীর ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ গ্রন্থটিতে দুএকটি বানান ভুল ছাড়া বইটি অনিন্দ্য সুন্দর। বইটির ভেতর তেমন কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। অসাধারণ হয়েছে বইটির প্রচ্ছদ। ধন্যবাদ প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর আপনাকে। প্রকাশক : খড়িমাটি। খড়িমাটির কাজের প্রশংসা শুনেছি বহুবার। আমরা শৈবাল চৌধূরীর এ বইটির বহুল প্রচার, প্রসার ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App