×

জাতীয়

গোল্ডেন মনিরের পেছনে কে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৩৭ এএম

রাজউক-গৃহায়ণ ও গণপূর্তে আতঙ্ক প্রতিমন্ত্রীর মুখে কুলুপ সচিবের দপ্তরে গোয়েন্দা তদন্তে কমিটি হ মাঠে দুদকও

হঠাৎ করে ‘গোল্ডেন মনির’কে র‌্যাব গ্রেপ্তার করার পর প্রশ্ন উঠেছে এতদিন ধরে যারা তাকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে সেই ‘রাঘববোয়াল’ কারা? মনির গ্রেপ্তারের ৩ দিন পার হলেও সেই রাঘববোয়ালদের এখনো আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে বহু কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রাত্যহিক সূচি এলোমেলো হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা সোমবার এই প্রতিবেদককে জানান, গোল্ডেন মনির নিয়মিত এই মন্ত্রণালয়ে যাতায়াত করার পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের কক্ষে হরহামেশাই ঢুকে যেতেন। শুধু মন্ত্রণালয়ই নয়, পূর্ত ভবন ও রাজউকেও ছিল তার অনেক ক্ষমতা। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে শুধু তার প্রতিপত্তি দেখে যেতাম। মুখে টুঁ শব্দ করার সাহস ছিল না।

সেই ক্ষমতাধর গোল্ডেন মনির হঠাৎ করে কেন গ্রেপ্তার হলেন- এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গতকাল দিনভর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী দপ্তরে অবস্থান করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু পুরো বিষয় নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মো. শরীফ আহমেদ। আগের দিন রবিবার তিনি দপ্তরেই আসেননি। আর গতকাল সোমবার শেষ বিকালে দপ্তরে এলেও তার কক্ষে কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে পারেননি। একপর্যায়ে সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকারকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, প্রতিমন্ত্রীকে সরিয়ে দেয়া হতে পারে।

প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ভোরের কাগজসহ বেশ কয়েকটি টেলিভিশনের প্রতিবেদকরা জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। তিনি প্রতিমন্ত্রীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে জানান, ‘সাম্প্রতিক কোনো বিষয় নিয়ে স্যার এখন কথা বলবেন না। পরে কোনো একদিন সবার সঙ্গে আলোচনা করবেন।’

তবে অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন, বর্তমান প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ দায়িত্ব নেয়ার পর গোল্ডেন মনির প্রায়ই তার দপ্তরে আসতেন। দরজা আটকে রেখে তাদের দুজনের মধ্যে নানা কথাও হতো। কিন্তু কী কথা হতো তা জানা যেত না। তবে প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদে গোল্ডেন মনির যে লাভবান হয়েছে তা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। প্রতিদানে গোল্ডেন মনিরও দুহাত ভরে দিয়েছে প্রতিমন্ত্রীকে। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী কথা না বলায় এসব অভিযোগের জবাব জানা যায়নি। তবে প্রতিমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকী এসব প্রশ্নের জবাবে গতকাল ভোরের কাগজকে বলেছেন, ‘এটা ঠিক, স্যার প্রতিমন্ত্রী হয়ে এই মন্ত্রণালয়ে আসার পর গোল্ডেন মনিরও যাতায়াত করা শুরু করলেন। এই যাতায়াতের মধ্যে কোনো দেয়া-নেয়া ছিল কিনা তা বলতে পারব না।’ তবে এও ঠিক গত কিছু দিন ধরে তাকে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে আসতে দেখা যায়নি। কেন দেখা যায়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘হয়ত প্রতিমন্ত্রী স্যার তাকে না করে দিয়েছেন।’ অনেকেই বলছেন, গোল্ডেন মনিরের কাছ থেকে প্রতিমন্ত্রী একটি প্রাডো গাড়ি নিয়েছেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ হ্যাঁ, এরকম কথা আমিও শুনেছি। তবে এটা ঠিক, এরকম কোনো গাড়ি আমি দেখিনি। আমার মনে হয় এটা গুজব। গুজব কেন হবে? জবাবে তিনি বলেন, হঠাৎ একটা কিছু ঘটলে মানুষ নানা গল্প করে বেড়ায়। আমার কাছে মনে হচ্ছে, গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর সম্পর্কটিও মানুষের তৈরি গল্প।

প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বেরিয়ে উল্টোপাশে অবস্থিত সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকারের দপ্তরে গিয়ে দেখা করতে চাইলে ওখান থেকে বলা হয়, ‘সচিব স্যারের সঙ্গে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন মিটিং করছেন।’ প্রায় পৌনে একটার দিকে মিটিং শেষ হলে সচিবের দপ্তর থেকে ওই গোয়েন্দা সংস্থার ৩ জন সদস্যকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। তারা বেরিয়ে যাওয়ার আরো পরে সচিবের কাছে ভোরের কাগজ জানতে চায়, ওই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা কি গোল্ডেন মনির ইস্যুতে আপনার কাছে কোনো কিছু জানতে এসেছিলেন? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে চমকে ওঠে সচিব বলেন, ‘না না, তারা এই বিষয়ে নয়, অন্য আরেকটি বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলেন।’ গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন, এই মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল, বিষয়টি আপনি জানেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমিও বিষয়গুলো শুনছি। পাশাপাশি পত্রিকায়ও খবরগুলো পড়ছি। সব শুনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি আমরা। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (বাজেট) মো. মমতাজ উদ্দিন, এনডিসিকে। কবে কমিটি গঠন হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি একবার বলেন, গতকাল করেছি, আরেকবার বলেন আজ হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটি তদন্তে কী কী বিষয় দেখবে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ওই যে পেপার-পত্রিকায় যা যা উঠেছে। অনেকেই বলেছেন গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে আপনার সখ্যতা ছিল এবং আপনি তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তার বক্তব্য, ‘কতজনে কত কথা বলে। সব কথা কি আমলে নিতে হবে’- কথাটি বলেই তিনি নথি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মমতাজ উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, সোমবার অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে তদন্ত কমিটি গঠনের চিঠি পেয়েছি। তদন্তে আপনারা কী কী বিষয় দেখবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেবল কমিটি গঠনের কাগজ পেয়েছি। এ অবস্থায় কোনো বিষয়ে তদন্ত করব তা আমার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) অফিসে এসে কোন কোন বিষয়ে তদন্ত করতে হবে তা জেনে কাজ শুরু করব। এদিকে গোল্ডেন মনিরের প্লট জালিয়াতির পেছনে রাজউকের কারো সম্পৃক্ততা থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাজউক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম। তিনি বলেন, এগুলো আমরা তদন্ত করব। তদন্তে যারা যারা শনাক্ত হবে তাদের সবার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। নতুন করে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে আরো কারা কারা জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গোল্ডেন মনির বিএনপির রাজনীতি করতেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের হাত ধরেই তার উত্থান। মূলত মির্জা আব্বাসের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ওই সময় থেকেই পূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউকে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও তার দাপট এতটুকুও কমেনি; বরং আরো বেড়েছে। এনিয়ে সরকারের মধ্যে এখন তোলপাড় চলছে।

এদিকে, গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ আদালতের মাধ্যমে মনিরকে ৩ মামলায় ১৮ দিনের রিমান্ডে নেয়। এরআগে সম্পত্তির বিষয়ে তার বিরুদ্ধে দুদকে একটি মামলা ছিল। সম্পদের বিষয়টি তারাই খতিয়ে দেখছে। কিন্তু অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে হওয়া মামলার তদন্ত করছে পুলিশ। গতকাল সোমবার ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, প্রথম দিনের জিজ্ঞাসাবাদে মনির অটল রয়েছেন। কোনো ভাবান্তর নেই। উল্টো মনির পুলিশকে জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা ঠিক নয়। বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকা ও সোনার বিষয়টি আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ রয়েছে। আর মনীর ও তার স্ত্রীর নামে দুটো করে মোট ৪টি লাইসেন্সধারী অস্ত্র রয়েছে। এরমধ্যে বিদেশ যাওয়ার কথা থাকায় অস্ত্রগুলো গুলশানের একটি দোকানে জমা রাখা হয়েছিল। সেখানে আমি কেন আরেকটি অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ঘুমাতে যাব- উল্টো পুলিশকে এভাবেই প্রশ্ন করেন গোল্ডেন মনির। উদ্ধার হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা সম্পর্কে গোল্ডেন মনির জানান, এসব আমার পাসপোর্টে সংযুুক্ত করা আছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার এলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, তার বিরুদ্ধে যেসব বিষয়ে অভিযোগ উঠেছিল সে বিষয়গুলো আমরা যাচাই করে দেখছি। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App