×

মুক্তচিন্তা

অর্থনীতি কী করোনা জয়ের পথে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২০, ১০:৫৯ পিএম

অর্থনীতি কী করোনা জয়ের পথে
কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি রীতিমতো কাঁপছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এক চীন ছাড়া সব বড় অর্থনীতিই সংকুচিত হয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে এবারের অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত কিছু দেশের জন্য আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। চলতি বছর বিশ্বের ৭ থেকে ১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের শিকার হবেন। ১৯৯০ সালে বিশ্বজুড়ে চরম দরিদ্র মানুষ ছিল ২০০ কোটির মতো, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ শতাংশ। গত বছর সেই সংখ্যা নেমে এসেছিল ৬৩ কোটিতে, যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মাত্র। এসব চরম দরিদ্র লোকের বেশির ভাগই আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের বাসিন্দা। তবে এবারের মহামারিতে চরম দারিদ্র্য হতে যাওয়া অর্ধেকের বেশি মানুষই দক্ষিণ এশিয়ার। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সঙ্গে এক যৌথ গবেষণা শেষে জাতিসংঘ জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস মহামারিতে ৭০টি দেশের ৪৯ কোটি মানুষ দরিদ্র হচ্ছেন। যাদের বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ, পর্যাপ্ত খাবার নেই, সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর মতো পরিস্থিতি নেই। এর কারণে বিশ্ব অন্তত এক দশক পিছিয়ে যাবে। আগের যে কোনো মন্দার তুলনায় এবারের সংকটে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, মহামারির কারণে বিদেশে কর্মরত অনেকেই আগের মতো অর্থ পাঠাতে পারছেন না। ফলে চলতি বছর প্রবাসী আয় কমে যেতে পারে এক-পঞ্চমাংশ পর্যন্ত, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসের সর্বোচ্চ। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সম্ভবত জীবিকার জন্য শহরনির্ভর মানুষরা। ভারতেই অন্তত ১ কোটি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। সব মিলিয়ে ভয়াবহ এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন নতুন দরিদ্ররা। করোনায় শ্রমজীবী মানুষের আয় কমেছে। লাখ লাখ কর্মজীবী বেকার হয়ে গেছেন। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় ৪ হাজার টাকা। পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় বেকারত্ব ওই সময়ে দশগুণ বেড়ে যায়। আড়াই শতাংশ বেকারত্ব হার পৌঁছে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থনীতি খুলতে শুরু করায় জুলাই থেকে বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়। সেপ্টেম্বরে এসে বেকারত্বের হার আবার ৪ শতাংশে নেমে আসে। এত দ্রæত বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ করোনার প্রথম তিন-চার মাস যত বেকার হয়েছেন, তাদের অনেকেই এখনো কাজ পাননি। চাকরির বাজার এখনো আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি। অর্থনীতির নিষ্ক্রিয়তায় দেশে সংকুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদে কর্মসংস্থান হারাবে ১১ লাখ তরুণ। আর দীর্ঘমেয়াদে এ সংখ্যা ১৬ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমন বাস্তবতায় করোনার হানা অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এলোমেলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গত কয়েক মাসে কর্মহীন, চাকরি হারানো বা বিদেশ ফেরত লোকের সংখ্যা আরো বেড়েছে। নতুন নিয়োগ বা কাজের জোগান বর্তমান অবস্থায় খুবই সীমিত। বেসরকারি সংস্থা সানেমের গবেষণা বলছে দরিদ্রের হার বেড়ে যেতে পারে। নতুন বাজেটের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, বহুমুখী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সেবা নিশ্চিত করার মতো বিষয় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে বলে মনে করে সানেম। করোনার এই মহামারিকালে অনেক নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে ইতিবাচক তথ্য হলো ক্রমেই গতিশীল হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা, শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রম ও সরকারের সহযোগিতা এই তিন উদ্যোগ এক হওয়ায় অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও জোরে ঘুরছে। এক্ষেত্রে সাহস জোগাচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতও সচল হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। তবে তার দৃষ্টিতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে বড় শক্তি হিসেবে ভ‚মিকা রাখছে গরিব কৃষকদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য। কারণ এখনো কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এখনো বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস কৃষি। কৃষকরা যদি খাদ্য উৎপাদন না করত, তাহলে বড় বিপদ হতো।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত টানা তিন মাসে রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, তা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ার সুফল পাচ্ছে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের সুবিধাভোগীরাও। রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো চাঙ্গা রয়ে গেছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। ব্যাংকের আমানতও বাড়ছে। দীর্ঘদিনের মন্দায় থাকা পুঁজিবাজারে প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করেছে। গলির দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পকারখানা সবই চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিবহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে। এদিকে করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে আরো বেশি ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসেবে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এমন অবস্থায় সব দাতা সংস্থাই বলছে, এত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। আইএমএফ বলছে, চলতি ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ গায়ানা ও দক্ষিণ সুদানের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। তবে আইএমএফ এও বলছে, করোনার আগের মতো ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বাংলাদেশকে আরো চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার জন্য চ‚ড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। কারণ যে তিনটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয়বার এই স্বীকৃতি পাবে কোভিড-১৯ সত্তে¡ও বাংলাদেশ সে সূচকগুলো অর্জন করতে সক্ষম হবে। ফলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো। করোনাকালে দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, অর্থনীতি যে গতিতে এগোচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অবশ্যই করোনাজয়ী হবে। এম এ মাসুম : ব্যাংক কর্মকর্তা ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App