×

মুক্তচিন্তা

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ : জরুরি করণীয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২০, ১১:২৪ পিএম

বিগত মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রথম আঘাত করেছিল করোনা ভাইরাস। গত ৯ মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত তথ্য মতে, প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। এই নিবন্ধটি সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হওয়ার মুহূর্তে সংখ্যা দুটি আরো বাড়বে এমন আশঙ্কা এমনকি বিশেষজ্ঞ মহলগুলোরও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন বিকেলে যে তথ্য করোনার ব্যাপারে প্রকাশ করে চলেছে তার সঠিকতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে সুদীর্ঘ ৯ মাসে তাদের হিসাব অনুসারেই পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ২৬ লাখ মানুষের। চিত্রটি মারাত্মকভাবে হতাশাব্যঞ্জক। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে প্রতিদিন নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে যত লোকের মৃত্যু ঘটে, তার শতকরা ৫ শতাংশের হয়তো হাসপাতালে ঘটে থাকে। বাদবাকি ৯৫ শতাংশ মৃত্যু ঘটে হাসপাতালের বাইরে-বিনা চিকিৎসায় বা টোটকা চিকিৎসায়। আবার নানা রোগে যারা প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন, তার হয়তো ২ থেকে ৩ ভাগ মাত্র হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। যে হারে চিকিৎসা বা মৃত্যুর কথা উল্লেখ করলাম, তা নিতান্তই অনুমান নির্ভর কারণ এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আজো আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। সংখ্যায় যদি কিছু কমবেশি হয়ও তা যে সত্যের অনেকটা কাছাকাছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নেই এ কারণে যে আমাদের দেশে স্বাধীনতার আসন্ন ৫০ বছর পূর্তির লগ্নেও হাসপাতালের সংখ্যা, ডাক্তারের সংখ্যা, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা মোট রোগাক্রান্তের শতকরা ১০ ভাগও না। যে কিছুসংখ্যক হাসপাতাল এ পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে তাতে সঙ্গতিসম্পন্ন মানুষদেরও খুব অল্পসংখ্যকই ভর্তির সুবিধা পাচ্ছেন বাদবাকি সবাইকেই গুনতে হচ্ছে ‘ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই’। সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবারগুলোর বিপুলসংখ্যক রোগীই যেখানে হাসপাতালে স্থানাভাবে ভর্তি হতে পারছেন না সেখানে সঙ্গতিহীন দারিদ্র্যপীড়িত লাখ লাখ রোগীর তো হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানোর যানবাহনের ভাড়া বহনের ক্ষমতাটুকুও নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রায় সবাই ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কাজ করেন আর অংশত চট্টগ্রামে। বাদবাকি বিশাল বাংলাদেশ? উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যে শুধু সন্তান সম্ভবা নারীদের সন্তান প্রসবের আংশিক সুবিধা মাত্র আছে, আর সর্দি, কাশি, পেট খারাপের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কিছু ট্যাবলেট মাত্র পাওয়া যায়, এ নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। শতকরা নারীর সন্তান প্রসব হাসপাতালেই হতে হবে, এমন কোনো বিধান আজো আমাদের দেশে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। আবার এ ব্যাপারে সচেতনতারও যে অভাব আছে তাও সত্য। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে সন্তান সম্ভবা নারীদের আধুনিক চিকিৎসা বা সন্তান প্রসবের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আবার চিকিৎসাক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং এক ধরনের চিকিৎসকদের সীমাহীন অর্থ লোভের কারণে স্বাভাবিক প্রসবযোগ্য মায়েদের অনেককেই অপারেশনের মাধ্যমে প্রসবের ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। অসহায় নারীরা এর শিকার হয়ে অনেকেই নানা জটিলতায় জীবনভর ভুগতে বাধ্য হন। অকাল মৃত্যুও ঘটে অনেক মায়ের ও শিশুর। চিকিৎসাব্যবস্থার এহেন বিপর্যস্ত পরিস্থিতির চিত্র অনেক সময়ই সংবাদপত্রের পাতায় উঠে এলেও তা নিরসনে কর্তৃপক্ষের যথাযথ হস্তক্ষেপ খুব কমই দৃশ্যমান হয়। ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক বিপর্যয় প্রতিদিন দেশের সর্বত্র ঘটিয়ে চলেছে অবাধে। করোনাকালে স্বাস্থ্য বিভাগের ও সরকারি হাসপাতালগুলোর দুর্নীতি ও বেসরকারি বহু হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিরাজমান ভয়াবহ পরিস্থিতির চিত্র জনসমক্ষে ধরা পড়েছে। প্রয়োজন হলো ঊর্ধ্বতন মহলের দ্রুত হস্তক্ষেপের। জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে সরকার প্রস্তুত। তৃণমূল পর্যায়ে কিন্তু এই প্রস্তুতি কারো নজরে পড়ছে না। প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, টেস্টিং কিটসের কথা। জেলা উপজেলাগুলোতে করোনা শনাক্ত করার জন্য অপরিহার্য প্রয়োজন ব্যাপকসংখ্যক মানুষের করোনা পরীক্ষা। প্রতি উপজেলায় প্রতিদিন ৫০০ করে মানুষের পরীক্ষা বিনামূল্যে বাধ্যতামূলকভাবে করা প্রয়োজন। কিন্তু উপযুক্ত নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় টেস্টিং কিটস ও জনবলের প্রচণ্ড অভাব। দ্বিতীয় ঢেউ যে ভয়াবহ আকারে সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে এবং এশিয়ার ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছে তা গভীরভাবে আতঙ্কজনক। বাংলাদেশেও এর লক্ষণ স্পষ্ট। নতুন করে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন শীতের প্রকোপে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এ কথা বলার পর একটি কথাও বলেননি উদ্ভ‚ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সবাই যেন পরীক্ষা করে জানতে পারে তার ও তাদের দেহে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে কি না। তা নিশ্চিত করার জন্য দেশব্যাপী সরকারিভাবে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার বিস্তারিত উল্লেখ তার বক্তব্যে নেহায়েতই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু মানুষ হতাশ হয়েছে। যে কথা সরকারিভাবে বলা হচ্ছে বারবার তা হলো বাইরে যেতে হলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে, স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখতে হবে। এগুলো যথার্থ উপদেশ কারণ এগুলো সবারই মানা প্রয়োজন করোনা প্রতিরোধ করতে হলে। তবুও বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক পরছেন না দেখে কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নির্দেশ অমান্যকারীদের জেল-জরিমানার শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এতে কারোরই আপত্তি নেই। এর সঙ্গে অবশ্যই ভাবতে হবে যারা মাস্ক পরছেন তারা একটা মাস্ক দিয়েই মাসের পর মাস চালাচ্ছেন কিনা, মাস্কগুলো বিজ্ঞানসম্মত কিনা যারা কিনতে পারছেন না তাদের জন্য বিজ্ঞানসম্মত মাস্ক প্রাপ্তির ব্যবস্থা কি? সরকার বাইরে যাওয়া শতভাগ লোককে মাস্ক পরে যেতে বলার সঙ্গে সঙ্গে একই বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। সরকারিভাবে ওষুধের দোকানগুলোতে বিজ্ঞানসম্মত মাস্ক সরবরাহ করার জন্য এবং নকল ও বিজ্ঞানসম্মত নয় এমন সব মাস্ক বাজার থেকে কার্যকরভাবে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা অবশ্যই প্রয়োজন। কিটস নেই ঢাকার বাইরে কোথাও এ কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। পত্রিকায় দেখলাম মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঢাকায় একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বেশকিছু সংখ্যক মাস্ক ও অপরাপর স্বাস্থ্য সামগ্রী হস্তান্তর করলেন। আমাদের অ্যামবাসি ও হাইকমিশনগুলোকে মানসম্মতও মাস্ক নানা দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে কিনে বা সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য নির্দেশ জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন। কিটসের ক্ষেত্রেও একই সুপরিশ করব। কিটস দ্বারা নমুনা নেয়া যাবে কিন্তু পরীক্ষা কোথায় হবে? তার জন্য সর্বত্র পিসিআর ল্যাবের প্রয়োজন কিন্তু তা ঢাকাসহ মাত্র কয়েকটি শহরে আছে তাও জেলা বা বিভাগীয় হেডকোয়ার্টারের হাসপাতালগুলোতে। বিশাল বাংলাদেশের অপরাপর জেলা-উপজেলায় আদৌ সে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রত্যাশা এই যে কার্যকরভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে সর্বত্র যথেষ্ট সংখ্যক ল্যাব অতি সত্বর জরুরিভিত্তিতে স্থাপন করে দ্রæত করোনা পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে প্রয়োজনে চিকিৎসা এবং নেগেটিভ ফল এলে তাদের নিশ্চিন্ত হওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। চিকিৎসা হবে কোথায়? ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড আজো স্থাপন করা হয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় ওয়ার্ডের বা স্থানের স্বল্পতা প্রতিটি হাসপাতালে রয়েছে রয়েছে করোনা ছাড়া প্রচলিত রোগাক্রান্তদের অসম্ভব ভিড়। তবু একদিকে যেমন এ সত্ত্বেও প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ড অবশ্যই স্থাপন করতে হবে, তেমনই সব হাসপাতালে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আইপিইউ, ভেন্টিলেশন ও অক্সিজেন মজুত রাখার ও করোনা চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের ব্যবস্থাও অপরিহার্য। আশার কথা, শিগগিরই করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসছে, বিদেশি খ্যাতনামা কোম্পানিগুলো এমন আশাবাদের সৃষ্টি করছেন। উৎসাহের সঙ্গে ওই খবরগুলো আমাদের সংবাদপত্রগুলোও প্রকাশ করে চলেছে তৃণমূল পর্যায়ে ওই আশাবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, সরকার ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন ভ্যাকসিন কেনার জন্য। খবরটি আশাপ্রদ। কিন্তু এরপরও তো কথা আছে ১. আমদানিকৃত ভ্যাকসিন পরিবহন ও দেশের নানা স্থানে সংরক্ষণের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা আছে কি? না থাকলে দ্রæত সে ব্যবস্থা নিতে হবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে। ২. আমদানিকৃত ভ্যাকসিন ধাপে ধাপে কারা পাবেন তার সঠিক অগ্রাধিকার নির্ণয় করে সেগুলো তাদের দেহে প্রয়োগের ব্যবস্থা নির্ণয় অবিলম্বে করা প্রয়োজন। প্রথম অগ্রাধিকার ডাক্তা, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং তাদের পরিবার পরিজন, পুলিশ পেতে অধিকারী। ৩. এরপরে ষাটোর্ধ্ব সব নারী-পুরুষ। ৪. সব মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার পরিজন। ৫. সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ক্রীড়াবিদ, সংস্কৃতিকর্মী প্রভৃতি। ৬. অতঃপর শহর ও গ্রামের সব নাগরিক যাতে স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন পান তারও ব্যবস্থা সরকারিভাবেই করতে হবে। এই ব্যবস্থাগুলো নিলে দেশবাসী নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সঠিকভাবে প্রতিকার করা হয়তো সম্ভব হবে। রণেশ মৈত্র : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App