×

জাতীয়

গোল্ডেন মনিরের সোনার খনি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪১ এএম

গোল্ডেন মনিরের সোনার খনি!

মনির/ফাইল ছবি

দুবাইয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগেই র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ৬০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার হ দুই শতাধিক প্লটের মালিক

রাজধানীতে শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়া এক ব্যক্তির অগাধ বিত্ত-বৈভবের খোঁজ পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ঢাকা ও আশপাশে তার নামে-বেনামে রয়েছে দুই শতাধিক প্লট। সংগ্রহে রয়েছে ৬০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, বৈদেশিক মুদ্রা ও অবৈধ অস্ত্র। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের জালে গতকাল শনিবার মধ্যরাতে আটক হওয়া এ ব্যক্তির নাম মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। ২০ বছর আগে রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি কাপড়ের দোকানে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করা এ ব্যক্তিকে আটকের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র‌্যাব।

কাপড় দোকানের বিক্রয় প্রতিনিধি থেকে ক্রোকারিজ দোকানের মালিক মনির বিমানবন্দরে লাগেজ ব্যবসায় নেমেই অপকর্ম শুরু করেন। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে মালামাল আনা শুরু করেন তিনি। এরপর জুয়েলারি ব্যবসায় নেমে জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাচালানে। এরই মধ্যে প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত কর্মকর্তা ও রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করে কাগজপত্র জালিয়াতি করে হয়ে যান অনেক প্লটের মালিক। তারপর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বদলে যায় তার জীবনযাত্রার ধরন। বনে যান হাজার কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠে তার নেটওয়ার্ক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে খুঁজছে এমন খবর আঁচ করতে পেরে চিকিৎসার নামে দুবাই পাড়ি জমানের সব আয়োজন ছিল চূড়ান্ত। এর আগেই ধরা পড়েন র‌্যাবের জালে। সাড়ে ১২ ঘণ্টার টানা অভিযান শেষে র‌্যাব তার মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে উদ্ধার করে ৬০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, একটি বিদেশি পিস্তল, চারটি গুলি, চার লিটার বিদেশি মদ, ৩২টি নকল সিল, ২০ হাজার ৫০০ সৌদি রিয়াল, ৫০১ ইউএস ডলার, ৫০০ চাইনিজ ইয়েন, ৫২০ রুপি, ১ হাজার সিঙ্গাপুরের ডলার, ২ লাখ ৮০ হাজার জাপানি ইয়েন, ৯২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, হংকংয়ের ১০ ডলার, ১০ ইউএই দিরহাম ও ৬৬০ থাই বাথ। দেশীয় মুদ্রায় এগুলোর মূল্যমান দাঁড়ায় ৮ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৬ টাকা। এছাড়া গোল্ডেন মনিরের বাসার নিচের পার্কিংয়ে পাওয়া যায় বিলাসবহুল দুটি প্রাডো গাড়ি। যার বৈধ কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি তিনি। আরো তিনটি অবৈধ গাড়ি জব্দ করা হয় তার মালিকানাধীন অটোকার সিলেকশন থেকে। এর আগে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা রাখার অভিযোগে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের মেরুল বাড্ডার ১৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাড়িতে গত শুক্রবার রাত ১১টা থেকে অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

অভিযান শেষে গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলন বাহিনীটির লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ’৯০-এর দশকে গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন মনির। এরপর রাজধানীর মৌচাকের একটি ক্রোকারিজ দোকানে তিনি কাজ নেন। সে সময় এক লাগেজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হলে ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকা-সিঙ্গাপুর ও ভারত রুটে তিনি প্রথমে লাগেজে করে কাপড়, কসমেটিক, ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটারসামগ্রী, মোবাইল, ঘড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনা-নেয়া করতেন। এই কাজগুলো করতে করতে তিনি লাগেজ স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। বায়তুল মোকাররমে একটি জুয়েলারি দোকান দেন, যা তার এই চোরাকারবারি কাজে সাহায্য করে। এসব করতে করতেই মনির বড় ধরনের স্বর্ণ চোরাচালানকারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির। চোরাচালানের দায়ে ২০০৭ সাল বিশেষ ক্ষমতা আইনে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়।

[caption id="attachment_252443" align="alignnone" width="1032"] জব্দকৃত সোনা, টাকা ও অস্ত্র। ছবি: ভোরের কাগজ।[/caption]

তিনি আরো বলেন, ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে মনির অসংখ্য প্লটের মালিক হয়েছেন। রাজউক থেকে প্লটসংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র চুরি করে ও অবৈধভাবে রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করে রাজউক, পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা এবং কেরানীগঞ্জে নামে-বেনামে অন্তত ২০০ প্লট নিজের করে নেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মনির ৩০টির বেশি প্লটের কথা স্বীকারও করেছেন।

র‌্যাবের এ মুখপাত্র বলেন, ৭০টি ফ্ল্যাটের নথি আইনবহির্ভূতভাবে হেফাজতে রাখায় গত বছর মনিরের বিরুদ্ধে রাজউক কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করে। যা চলমান রয়েছে। এছাড়া দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিপুল সম্পদ অর্জন করায় তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলছে।

ভূমি জালিয়াতি সম্পর্কে মনিরের বরাত দিয়ে আশিক বিল্লাহ বলেন, ২০০১ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত কর্মকর্তা ও রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভূমি জালিয়াতি শুরু করেন। মনিরের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ জানান, একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। সেই দলটির অর্থ জোগানদাতা হিসেবেও তিনি কাজ করেন। তবে দলের নাম উল্লেখ করেননি তিনি।

জানা গেছে, গোল্ডেন মনির নিজের নিরাপত্তায় লাইসেন্সকৃত দুটি আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখতেন। এর মধ্যে একটি পিস্তল ও একটি শর্টগান। তবে বৈধ দুটি অস্ত্রের পাশাপাশি একটি অবৈধ পিস্তলও তার দখলে ছিল। যেটি তাকে আটকের সময় তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। বিদেশ যাওয়ার জন্য নিজের লাইসেন্সকৃত দুটি অস্ত্র বাড্ডা থানায় জমাও দিয়েছিলেন তিনি। তবে এ বিষয়ে বাড্ডা থানার অফিসার ইনচার্জ পারভেজ ইসলাম জানান, গোল্ডেন মনিরের অস্ত্র জমা দেয়ার বিষয়টি তার জানা নেই।

এদিকে দুবাইয়ে পালিয়ে যেতে গোল্ডেন মনিরের সব প্রস্তুতিই সম্পন্ন ছিল। গতকাল গ্রেপ্তার এড়াতে পারলেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতেন। গতকাল বেলা ১১টার দিকে এমিরেটস এয়ারলাইনসের (ই কে-৫৮৫) ফ্লাইটে তার দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। তবে গোল্ডেন মনিরের ছেলে মোহাম্মদ রাফি হোসেন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তার বাবা প্রায়ই চিকিৎসার জন্য দুবাই যান। এবারো চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন। এর আগেই র‌্যাব তাকে আটক করে ফেলে। তবে মনিরের শারীরিক সমস্যা বা চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিয়ে পারেননি রাফি হোসেন।

বাবাকে নির্দোষ দাবি করে ছেলে আরো বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বাবা। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। আমরা আইনিভাবে সব মোকাবিলা করব। সেখানেই প্রমাণ হবে বাবা দোষী কিনা।

এদিকে মাদক, অস্ত্র ও মানিলন্ডারিং আইনে তার বিরুদ্ধে পৃথক ৩টি মামলা করাসহ দুদক, বিআরটিএ, সিআইডি ও ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার বিষয়ে এনবিআরকে তদন্তের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানাবে র‌্যাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App