×

মুক্তচিন্তা

ডিজিটাল বাংলাদেশে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২০, ০৬:২৪ পিএম

বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধাভাগী মানুষের সংখ্যাও বর্তমানে অনেক। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছে। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, এখনো দেশের সব সেবা খাতে শতভাগ ‘ডিজিটাল সেবা’ নিশ্চিত হয়নি। তা সত্তে্বও ডিজিটাল হওয়া তথা তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে এগিয়েছে বাংলাদেশ। অনেক সরকারি ও বেসরকারি সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আমরা কিছু কিছু সাফল্য লাভ করলেও ডিজিটাইলেজশনের নিত্যনৈমিত্তিক অপব্যবহারেও কম অতিষ্ঠ হচ্ছি না! বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন, সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগ্রত রাখাসহ শিক্ষা ও গবেষণায় চরম উৎকর্ষ লাভের অভিপ্রায় থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তির এই বিপ্লবকে অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি নেতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডেও ব্যবহার করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সমাজে এর অপব্যবহারের ফলাফল অনেক গভীর এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের মাত্রাহীনতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথা ‘সাইবার জগতে’ আমরা চরম নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে আটকা পড়েছি, দিন দিন একবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছি!

মানব উন্নয়নের যে মহত্তর মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর যে প্রত্যয় যুক্ত করেছিল তা ছিল মূলত ‘এগিয়ে যাওয়ার’ একটি দার্শনিক অভিপ্রায়। তখন লাখো তরুণের স্বপ্নের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রত্যয়ের গভীরে। ফলে সে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতকে ভূমিধস পরাস্ত করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন শুরু করে। আস্তে আস্তে দেশ ডিজিটাল হতে থাকে- অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু নানা বিষয়ে দেশে ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেও রাজনীতি এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে আওয়ামী লীগ নিজেই অনেকটা উদাসীন থেকেছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। উদাসীন থেকেছে আওয়ামী লীগের অন্য অঙ্গ সংগঠনগুলোও। কিন্তু দলটির অঙ্গ সংগঠনসমূহের বিভিন্ন শ্রেণির নেতাকর্মীর অনেকেই অর্থ-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় বরং উদাসীন থাকেননি! সে ছাত্রলীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হোক কিংবা যুবলীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহারের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারেও অনেকেই যশশ্বী হয়েছেন, পক্ষান্তরে তারা দলের জন্য যা করেছেন তা কেবলই ‘লবডংকা’ বিশেষ!

বিগত প্রায় এক যুগে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে আওয়ামী লীগ তেমন সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেনি। করলেও প্রতিপক্ষের তুলনায় তা নগণ্য। আবহমান বাঙালির সংস্কার-সংস্কৃতি, শাশ্বত মূল্যবোধ, হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কলা এবং সর্বোপরি মহান সংবিধানের অন্যতম দুটি স্তম্ভ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র বিষয়ে ‘সাইবার জগতে’ ডিজিটাল প্রযুক্তির কোনো রকমের ন্যূনতম ভ‚মিকা রাখতেও দলের মধ্যে দেখা যায়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের নতুন ও পুরনো সব ধরনের শত্রæপক্ষ ডিজিটাল বাংলাদেশের সব সুবিধা নিয়ে অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তির সব সুবিধা ব্যবহারের মাধ্যমে মহান সংবিধানের বর্ণিত দুটি স্তম্ভের মৌলিক আদর্শ ও দর্শনকে ভ‚লুণ্ঠিত করার প্রয়াস থেকে মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। একেই বলে ‘অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস’! আওয়ামী লীগের প্রবর্তিত তথ্যপ্রযুক্তির এই বিপ্লবকে অবলম্বন করে একটি বিশেষ মহল এখনো নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু গোষ্ঠীবিশেষই নয়- আওয়ামী বিদ্বেষী সবাই অনেকটা প্রায় অদৃশ্যভাবে জোটবদ্ধ হয়েই যেন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। ঘৃণা ছড়াচ্ছে শাশ্বত সংস্কৃতি তথা বাঙালির জাতীয়তাবাদী আদর্শের ওপর, ঘৃণা ছড়াচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা ব্যাখ্যা দিয়েও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় সবাই যেন এই অপশক্তির প্রবল দখলদারিত্বের আওতায় চলে গেছে! ফলে প্রাগসর চেতনাসম্পন্ন যাবতীয় অগ্রগতি আজ এক প্রকার বিপন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তাই হতাশার এক সুর নিরন্তর মনের ভেতর বেজে চলে তীব্র এক প্রশ্নচিহ্নকে আশ্রয় করে। সে প্রশ্ন- জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ তবে কার জন্য, ডিজিটাল বাংলাদেশ কি তবে বেহাত হয়ে গেল? রাজনৈতিকভাবে এই গোষ্ঠীর লোকরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেমন অপপ্রচার চালাচ্ছে তেমনি অপপ্রচার চালাচ্ছে বাঙালির শাশ্বত সংস্কার-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে- বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেও এই অপপ্রচার থেমে নেই। অনেক স্থলে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, জয় বাংলা প্রভৃতি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে সুচতুর ও সূ² কৌশলেও তারা বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে! ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। এই অপপ্রচারে যারা অংশগ্রহণ করছে তাদের কারো কারো সরাসরি রাজনৈতিক এজেন্ডা সক্রিয় এবং কারো বা ধর্মের আড়ালে লুক্কায়িত রয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দিবাস্বপ্ন!

ডিজিটাল জগতের বাইরেও (এনালগ) অনেক ধর্মসভায় ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ এবং বিশেষত ‘নারী নেতৃত্ব’ নিয়ে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপাত্মক বক্তব্য দেয়া হলেও অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস হিসেবে সেখানেও দেখা যায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদরা প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করে থাকেন। এসব দেখে-শুনে বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের পক্ষে আওয়ামী লীগের ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভরসায় আশ্বস্ত থাকবেন জানি না। জাতীয় সংসদের সদস্যরা দেশের এবং বিশেষত স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন, প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্ম সভাকেন্দ্রিক যেসব গণজমায়েতে নারী বিদ্বেষী, নারীর ক্ষমতায়ন বিদ্বেষী এবং নারী নেতৃত্ববিরোধী ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় সেসব তো সংশ্লিষ্ট সাংসদেরই নিয়ন্ত্রণে রাখবার দায়িত্ব! বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হলে তো কথাই নেই! আমরা তো জানি সব সাংসদের কাছেই নানা ধরনের গোয়েন্দা রিপোর্ট থাকে। যেসব সভায় সাংসদ বা মন্ত্রীরা আমন্ত্রিত থাকেন সেসব সভায় প্রধান অতিথির আগমনের পূর্বে যে ধরনের বক্তব্য প্রচার হয় গোয়েন্দা সংস্থার যথাযথ তথ্য থাকলে মন্ত্রী-সাংসদ তো অনেক পরের কথা আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মীরও সে সভায় উপস্থিত থাকার কথা নয়! কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটছে। এতে নারী নেতৃত্ব ও নারীর ক্ষমতায়নে অবিশ্বাসীরা এক ধরনের ভরসা পেয়েই ধর্মের নামে মনগড়া বক্তব্যের মাধ্যমে, হাস্যরস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগটি লুফে নিচ্ছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে- নাম ‘সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)’। জানা যায়, সিআরআইয়ের অধীনে সমগ্র বাংলাদেশে ৩১৫টির বেশি সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। তার মধ্যে ১৭ নভেম্বর ৩০টি সংগঠনকে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এসব সংগঠনে প্রায় তিন লাখ সদস্য, ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে। সংগঠনটির লক্ষ্য ‘ভিশন ২০২১’-এ দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তরুণ প্রজন্মকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা এবং তরুণদের নতুন নতুন উদ্ভাবনকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা। আমরা কি আওয়ামী লীগের কাছে এমন প্রত্যাশা করতে পারি না যে, সিআরআই আরো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। তথ্য ও প্রাযুক্তিক শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে সাইবার জগতে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রতিক্রিয়াশীল সব অপপ্রয়াসকে মোকাবিলা করুক। তা না হলে হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কেবলই বলতে হবে কার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ অলক্ষেই কার গেল!

অনেক বিভ্রান্তি ও হতশ্বাসের পর সম্প্রতি সহসা আশার সুর শুনতে পাওয়া গেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কণ্ঠে। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাকালীন ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি থেকে সরে যেতে পারে না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা যে ধর্মেরই হই না কেন আমরা সবাই বাঙালি।’ বিগত ১৭ নভেম্বর মধ্যরাতে ‘ইয়াং বাংলা’ আয়োজিত ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগের টানা প্রায় এক যুগের শাসনামলে উচ্চ পর্যায়ের কোনো নেতার মুখ থেকে এমন প্রত্যয়ী ও স্পষ্ট উচ্চারণ শোনা যায়নি। শোনা যায়নি অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার কোনো ঘোষণা, শোনা যায়নি বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমুন্নত রাখার স্পষ্ট কোনো অঙ্গীকারও। তাই সম্প্রতি সজীব ওয়াজেদ জয়ের এই উচ্চারণে আমরা আশ্বস্ত বোধ করছি। কিন্তু আশ্বস্ত বোধ করার পাশাপাশি এই আশঙ্কাও আমাদের মনে জাগে যে, তিনি এখনো আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের কোনো ‘নেতা’র পদ গ্রহণ করেননি। তাই তার এই বক্তব্য নিয়ে দলের ভেতরেই যদি ‘পলিটিক্স’ শুরু হয়ে যায় তবে আমাদের নির্মম অদৃষ্টকেই বরণ করে নিতে হবে! যারা অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেন, যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করেন তাদের মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। বাঙালি বলে আর গর্ববোধ করা সম্ভব হবে না। কবি বলেছিলেন, ‘বিশ্বমানব হবি যদি, কায়মনে বাঙালি হ’। আমরা কি সেই মানুষও হতে পারব কখনো?

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App