×

মুক্তচিন্তা

বাইডেন প্রশাসনের নীতি কেমন হবে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২০, ০৫:৫৮ পিএম

জো বাইডেনের শপথ নেয়ার বিষয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঘরের মধ্যে তাকে মুখোমুখি হতে হবে তিক্তভাবে বিভক্ত রাষ্ট্রের। বাইডেনের মনোযোগ পররাষ্ট্রনীতিতে নিবদ্ধ করতে পারে গৃহের তিক্ততা। আরো কিছু কারণে ট্রাম্প যেমন বহির্বিশ্বের দিকে পিঠ ফিরিয়ে রেখেছিলেন, এর বিপরীতে বহির্বিশ্বকে আলিঙ্গন করবেন বাইডেন। তার প্রথম কারণ পররাষ্ট্রনীতিতে অভিজ্ঞ আমেরিকায় জীবিত যে কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছেন তার মধ্যে জো বাইডেন অন্যতম। একজন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তো বটেই, দীর্ঘদিন সিনেট বৈদেশিক কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তার পররাষ্ট্র টিমের সবাই অভিজ্ঞ। এরই মধ্যে তার টিম সবচেয়ে বড় তিনটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে, যেমন- কোভিড, ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও চীন। বাইডেন এ তিন ইস্যু নিয়ে কাজ করলে ইউরোপ ও এশিয়াকে নিজের পাশে পাবে যুক্তরাষ্ট্র। কয়েকদিন আগে অফিসিয়ালি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে আবার অন্তর্ভুক্তিই হতে পারে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রথম পদক্ষেপ। এছাড়া মানবাধিকার, অভিবাসন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ ইউরোপীয় নীতিতে অনেকটা নমনীয় ও যৌক্তিক হবে বলে বিশ্ববাসীর ধারণা।

২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জো বাইডেন। এর আগে দীর্ঘ সময় ধরে সিনেটর ছিলেন তিনি। সেই সময় একাধিকবার অভিবাসন ও জলবায়ু ইস্যুতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন বাইডেন। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ১০০ দিনের মধ্যেই ট্রাম্পের অভিবাসন সংক্রান্ত অনেক সিদ্ধান্ত ও নীতি বাতিল করে দেবেন। বিশেষ করে ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অভিবাসন নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা বাতিল করবেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রায় ৬ লাখ অভিবাসী রয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই থাকেন নিউইয়র্কে। তবে এসব অভিবাসীর মধ্যে বৈধ ও অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে অভিবাসন নীতি কঠোর হলেও বাইডেন প্রশাসনের আমলে তা অনেকটা শিথিল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। আর সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী বাংলাদেশি নাগরিকরা সুবিধা পেতে পারেন, বিশেষ করে অবৈধ অভিবাসীরা বৈধ হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় বৈশ্বিক ফোরামে কাজ করছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বে যে কয়েকটি দেশ অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে জোর দিয়েছেন জো বাইডেন। নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু ইস্যুতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের একযোগে কাজ করা আরো সহজ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অভিবাসন ও জলবায়ু ইস্যুতে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, জো বাইডেন জলবায়ু ইস্যুতে সোচ্চার, অভিবাসী ইস্যু নিয়েও তিনি সোচ্চার। তবে বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তার নিজের স্বার্থ দেখে। তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। দেশের স্বার্থ ও ঐক্যের বিষয়ে এক ব্যানারে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি।

এশিয়ার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি হবে আগের প্রশাসন থেকে ভিন্নতর সে কথা তিনি তার প্রথম বিজয় ভাষণে জোর দিয়ে বলেন। আশা করা যায় তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেবেন। এছাড়া তার রানিংমেট এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ধমনিতে ভারতীয় উপমহাদেশের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণেই ধারণা করা যাচ্ছে, নতুন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নতি হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ওবামা প্রশাসনের সময় থেকে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। জো বাইডেনের প্রশাসনেও এ নীতি অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে। কারণ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাতে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত অবস্থানে আছে। সুতরাং নতুন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে অবশ্যই গুরুত্ব দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ সুবিধাগুলো ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করলে এখন তা পাওয়া যেতে পারে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে আমেরিকান ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কড়াকড়ি ছিল সেটাও তুলে নেয়া হবে বলে আশা করা যায়। আর এখন বাংলাদেশি ছাত্ররাও উচ্চশিক্ষা নিতে সহজেই যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবে। যেসব বাংলাদেশি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন তাদের প্রতি নতুন প্রশাসন সহানুভ‚তিশীল আচরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অতীতে ভারতের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক সবসময়ই ভালো ছিল, বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে ভারতের আদর্শগত সম্পর্ক অত্যন্ত সুখকর ছিল। তবে এখন মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদ কায়েমের মাধ্যমে সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ সৃষ্টি ও নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করে নতুন মার্কিন সরকার সম্ভবত এ ব্যাপারে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কেননা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত কঠোর। ট্রাম্প যেভাবে মোদিকে ‘বø্যাংক চেক’ বা যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন বাইডেন তা দেবেন না। একই সঙ্গে বাংলাদেশে যেন সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয় সেদিকেও নতুন মার্কিন সরকার নজর রাখবে। এমনকি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও তারা বিভিন্ন সুপারিশ করতে পারে, যা ট্রাম্পের সময় হয়নি।

পূর্ব এশিয়াজুড়ে সবচেয়ে বড় যে বাধা বাইডেন প্রশাসনকে মোকাবিলা করতে হবে তা হচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। অর্থনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন নানাভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে সামরিক শক্তির দিক থেকেও চীন এখন আগের মতো পিছিয়ে নেই। ফলে ভয় দেখিয়ে চীনকে বাগে আনার মতো পরিস্থিতি এখন আর নেই, যে চেষ্টা ট্রাম্প প্রশাসন করে যাচ্ছিল। আন্তঃপ্রশান্ত মহাসাগর অংশীদার বা টিপিপির মতো নতুন কোনো বহুপক্ষীয় কাঠামোতে চীনকে যুক্ত করে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কিনা, জাপান সেটা এখন বিবেচনা করে দেখছে এবং ওয়াশিংটনকেও হয়তো টোকিও এ বিষয়ে প্রভাবিত করতে পারে।

ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যযুদ্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন তার অনেক কিছুই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার রীতি-নীতির খেলাপ বলে বেইজিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। এটি পুনর্বিবেচনা করতে পারেন বাইডেন। সার্বিকভাবে বাইডেন শাসনে চীনের সঙ্গে কৌশলগত বৈরিতার মধ্যেও এক ধরনের কাজের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। আর করোনা-উত্তর সময়ে চীনবিরোধী সর্বাত্মক লড়াইয়ের যে ডংকা ট্রাম্প বাজাচ্ছিলেন সেটি কিছুটা স্তিমিত হতে পারে। তবে করোনা বিস্তারে চীনের পরিকল্পিত সম্পৃক্ততার ব্যাপারে বৈশ্বিক নীতি প্রণেতারা নিশ্চিত হলে অন্য এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে চীনের ব্যাপারে। ইউরোপের এক সেনাপ্রধানের আরেক মহাযুদ্ধের হুঁশিয়ারিতে সে ধরনের ইঙ্গিতই পাওয়া যায়। মোদির সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা সত্তে¡ও তারা আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে একপর্যায়ের সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল। এ ক্ষেত্রে চীনের অতি ঘনিষ্ঠতাকে বাধা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছিল পেন্টাগন থেকে। এমনকি নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার একটি উদ্যোগের সঙ্গেও ট্রাম্প প্রশাসনের গোপন সম্পর্ক রয়েছে বলে বলা হচ্ছিল। বাইডেন ক্ষমতায় চলে এলে সে এজেন্ডা এবার আর সামনে এগোবে বলে মনে হয় না। ডেমোক্রেট শাসনের সঙ্গে নতুন পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের সম্পর্কের উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে।

এখন গণতান্ত্রিক বিশ্বের সবার দৃষ্টি থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। বিশ্ব দেখতে চায় আগামী দিনগুলোতে কীভাবে জো বাইডেনের গণপ্রশাসন এগিয়ে যাবে। তাছাড়া সারা বিশ্বেই বাইডেনের একটা ইতিবাচক ইমেজ আছে, পাশাপাশি বাংলাদেশেও তার প্রচুর জনসমর্থন আছে। আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো গভীর হবে এবং এ সম্পর্কের নতুন একটা উন্নয়নসূচক আমরা দেখতে পাব। প্রত্যাশা থাকবে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বাইডেন প্রশাসন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App