×

মুক্তচিন্তা

চীনের কারখানাগুলো ভারত ও বাংলাদেশে আসছে না কেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২০, ০৬:২৩ পিএম

সব কারখানা ভারত আর বাংলাদেশে চলে এলে চীনের শ্রমিকরা কি আঙ্গুল চুষবে? সব আসবে না চীন-ক্ষেপা বিদেশি বিশেষ করে আমেরিকান বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে কারখানা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন করোনা সূচনারও বছর দেড়েক আগে ২০১৮-এর মার্চে। মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রাথমিক পরিণতি হিসেবে ৫৬টি কারখানা প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং ভারত এপ্রিল-মে ২০২০-এ বেশ জোরেশোরে ঘোষণা দিয়েছে চীনের বারোটা বাজল বলে, এক হাজার উৎপাদনকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান বস্তা বেঁধে ফেলেছে, শিগগির কাছা বেঁধে ভারতের দিকে ছুটে আসবে। আসতেই হবে, মোদি-ট্রাম্প মহব্বতের কারণে অচিরেই তা ঘটতে যাচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই সহস্র কারখানার স্থান সংকুলান করার সামর্থ্য ভারতের আছে, বাংলাদেশ এর সিকিভাগ ঠাঁই দিতে পারলেও আমরা সন্তুষ্ট। আমরাও বলেছি, এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ। কারখানা আমরাও পাচ্ছি।

আসলে বাণিজ্য যুদ্ধই প্রকৃত যুদ্ধ যারা ১৯১৪-১৯১৯-এর যুদ্ধকে প্রথম মহাযুদ্ধ বলেন তারা ইতিহাস ও বাণিজ্যের গুরুত্বকে অস্বীকার করেন। ষোড়শ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া ওলন্দাজ-পর্তুগিজ যুদ্ধই পৃথিবীর প্রথম মহাযুদ্ধ। সে যুদ্ধে পর্তুগিজদের হাত থেকে বাঁচতে আমরাও (ভারতবর্ষ) ওলন্দাজদের পক্ষ নিয়েছিলাম। সে যুদ্ধেই প্রথম এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় দেশের অংশগ্রহণ ছিল। বাণিজ্য যুদ্ধই পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। রাজনীতিতেও বণিকের সাফল্য (বাংলাদেশ পার্লামেন্ট এমপিদের পেশার পরিসংখ্যান নিজেই সে সাক্ষ্য দেবে) অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে বেশি। অন্তত ভারতবর্ষের ইতিহাস তাই বলে। ১৬০০ সালের বাণিজ্যের সনদ নিয়ে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পৃথিবীর বৃহত্তম করপোরেট হিসেবে আবিভর্‚ত হয় এবং পৃথিবীর বহুলাংশ অধিকারও করে নেয়। দিন বদলে গেছে বলেই হয়তো চীনে অবস্থানরত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা দখলের কথা না ভেবে মানে মানে আম ও ছালা নিয়ে নিজেদের ‘রিলোকেট’ করার কথা ভেবেছে এবং ট্রাম্পগীতি গলায় সাধা মোদিজিও হাজার কোম্পানির জন্য দরজা খুলে রেখেছেন। যে কোনো দেশীয় বিনিয়োগকারীর জন্য প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মানুষের অভ্যন্তরীণ বাজারের চেয়ে বড় প্রণোদনা আর কি হতে পারে? ভারত তারই নিশ্চয়তা দিতে পারে। তার ওপর অবিশ^াস্য সস্তা শ্রমবাজার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে, শ্রমবাজার আরো সস্তা। আমাদের যেহেতু ধারণক্ষমতা কম ‘আগে আসিলে আগে পাইবেন’ অনুসরণ করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। এত বাদ্য বাজানোর পরও প্রথম ধাক্কায় বেরিয়ে আসা ৫৬টি উৎপাদনকারী কারখানার মধ্যে ২০১৯-এর শেষ নাগাদ ২৬টি ‘রিলোকেটেড’ হয়েছে ভিয়েতনামে, ১১টি গেছে তাইওয়ানে, ৮টি থাইল্যান্ডে। ভারত মার খায়নি, তিনটি এসেছে ১.৪ বিলিয়নের দেশে। করোনাকালে অনেক কিছু থমকে ছিল, এখনো আছে। এই রেশ কাটতে আরো সময় লেগে যাওয়ার কথা। এই ৫৬টির অবশিষ্ট কেউ বাংলাদেশে স্থিত হওয়ার সহি নিয়ত করেছে কিনা সে খবর এখনো সংবাদপত্রে আসেনি। বাকিরা কি নিজ দেশে চলে গেছেন? চীন থেকে আমেরিকান কোম্পানির ম্যানুফেকচারিং প্লান্ট চলে যাবে কেন? যত বাণিজ্য যুদ্ধের কথাই উঠুক এমন তো নয় যে চাইনিজরা কারখানার ভেতর বিস্ফোরক ভর্তি জর্দার কৌটা কিংবা পলিথিন ব্যাগে পেট্রল ভরে বোমা বানিয়ে ছুড়ে মারছে। বাংলাদেশি এতসব কায়দা-কানুন তারা শিখে উঠেনি এবং এটা ভালো করেই জানে কোম্পানি গুটিয়ে নিলে চাকরি হারাবে তাদেরই ভাইবোন। হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন চীন ক্ষুণ্ণ করছে কিংবা চীন হংকংবাসীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে সুতরাং লাভজনক ব্যবসা রেখে মা-বাবা তুলে মাও-এর দেশের লোকদের গালাগাল দিয়ে আমেরিকান ব্যবসায়ী চলে যাবে মনে করার সঙ্গত কোনো কারণ নেই। সরকার যাই বলুক, ব্যবসায়ীরা বলবেন যতক্ষণ লাভ হচ্ছে তাতে আমাদের কী এসে যায়। নিজস্ব কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস যদি চলে যাওয়া সমর্থন করে তবেই যাবে। পর্যাপ্ত সুবিধা, ‘রিলোকেশন কস্ট’ এবং উপযুক্ত ঋণ দিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র- এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতির কিছুটা তাহলে পূরণ হয়। ‘আমেরিকান ড্রিম’ লালন করে নাগরিকত্ব নিয়ে যারা বেকার জীবনযাপন করছেন, রাষ্ট্রের টাকা খাচ্ছেন তাদের কিছুটা হিল্লে তো করতেই হবে। প্রেসিডেন্ট বলেছেন আমেরিকান ‘সাপ্লাই চেইন’ তো পৃথিবীজুড়ে, কাজেই তাদের ফিরে আসতে হবে। প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা লেরি কুডলো বলেছেন, চীনফেরত কোম্পানিগুলো প্রত্যাবাসন খরচ বা রিপ্যাট্রিয়েশন কস্ট দেয়ার বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে। কাজটাকে ত্বরান্বিত করতে এশিয়ায় মার্কিন বিনিয়োগ হ্রাসের ঘোষণা আসি আসি করছে। প্যাঁচে ফেলার মতো কাজে আমেরিকা পিছিয়ে থাকবে না, সুতরাং ইউএস স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে চাইনিজ কোম্পানিগুলোর অপসারণও বিবেচিত হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ বাধা সৃষ্টি করার পথ তো খোলাই থাকল। তবে আমেরিকাও চিন্তিত কম নয়, চীন যদি আমেরিকাতে চীনা বিনিয়োগ ও চীন মেধা প্রত্যাহার করে নেয়ার ডাক দেয় তা হলে ত্রাহি রব সেখানেও উঠতে পারে। এর মধ্যে আবার সরকারও বদলে গেল, চীন নীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। আরো যে এক হাজার বা তার চেয়ে বেশি সংখ্যক কারখানা চীন ছাড়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বলে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এবং সেই সূত্রে যুক্তরাষ্ট্র ড্রাম পিটিয়ে ছিল, তারা কাছা খুলে ফেলেছেন কিনা সে খবর এখনো মেলেনি। যাই ঘটুক করোনা ভাইরাসের নাম চীনা ভাইরাস কি উহান ভাইরাস যা-ই হোক, করোনা আশীর্বাদ চীনই পেয়েছে, করোনা ব্যবস্থাপনা বাণিজ্য- মাস্ক থেকে শুরু করে পিপিই, লালা টানার সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে ভেন্টিলেটর বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই চীনের হাতে। চীন জানে কোথায় যাচ্ছে। সদ্য প্রকাশিত আইএমএফ অভিক্ষেপণ পত্র দেখিয়েছে মাথাপিছু আয়ের হিসাবে আসছে ৫ বছরে ২০২৫-এ দেশটি আরো ৫৬টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। তখন ক্রয়ক্ষমতা সমন্বয় করে মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২৫ হাজার ৩০৭ ডলার। আমেরিকার কোম্পানির চীন ছেড়ে যাওয়ার যত হিড়িকের কথাই শোনা যাক, তার অতি সামান্যই বাস্তবে ঘটেছে, বাস্তবে অতি সামান্যই ঘটবে। আর অতি সামান্যই ভারত কিংবা বাংলাদেশে ‘রিলোকেটেড’ হবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে নতুন বিনিয়োগকারীর আস্থা আমরা যে তেমন অর্জন করতে পারিনি এ সত্যটি স্বীকার করা দোষণীয় কিছু নয়। পর্যাপ্ত স্পিড মানি পকেট ঝেড়ে ফেলে সরকারি দল ও রাষ্ট্রীয় আমলার সন্তুষ্টি সাপেক্ষে একটি কোম্পানি রেজিস্ট্রি করতে ভারত কমপক্ষে ১৮ দিন লাগায়, কর্মকর্তা ও কর্মচারী, পার্টি ও সরকার কাউকে চাঁদা না দিয়ে ৯ দিনেই সে কাজ চীনে করা সম্ভব। তারপর ব্যবসায়ের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সবার সন্তুষ্টি বিধান করে ১২টি ধাপ পার করতে হয়। লাল ফিতের দৌরাত্ম্যের কথা ভারতীয় গবেষকরাই বলেছেন। তবে অর্থনীতিবহিভর্‚ত যেসব বাধা সে তালিকা ধরে অভিসন্ধর্ভ রচনা করা যায়। নির্মাণ অনুমোদনে পার করতে ৩৪টি ধাপ আর সবকিছু ভালোভাবে চললে ১১০ দিন সময় লাগে। যেহেতু রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকার উভয়েরই অনুমোদন নিতে হয় সে ক্ষেত্রে রাজ্য এবং কেন্দ্রের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করতেই হয়। চীনের কারখানা গুটিয়ে ভারতমুখী হওয়ার যত আমন্ত্রণই থাকুক, সেখানে এলেও দেখেশুনে ফিরে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের কয়েকটির সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বেশ মিলে যায় : ক. সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কারখানা স্থাপন করতে দেবে কি দেবে না তার নিশ্চয়তা নেই, দিলে কতদিনের মধ্যে তাও সবার জানা। খ. মৌলিক সংস্থান- ভূমি, প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ ও পানি স্বল্পতম সময়ে পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ভূমি অধিগ্রহণ সবচেয়ে জটিল ও সময়সাপেক্ষ। কোনো কারণে সে জমি মামলায় জড়িয়ে গেলে প্রকল্প পরিত্যক্ত, ‘ডুবে যাওয়া খরচ’ ভারতে রেখেই ফিরে যেতে হয়। গ. অদক্ষ ও অপরিণত ভৌত অবকাঠামো কারখানার সঙ্গে সংযোজক রাষ্ট্রীয় সড়ক বিপুল অর্থে নির্মাণ করা হয়ে থাকলে গুরুত্বপূর্ণ লোকদের চাঁদা দেয়া ও খুশি করাতে ব্যয়িত অংশ নিম্নমানের মাল দিয়ে রাস্তা তৈরি করায় ভারী ট্রাকের কয়েক ট্রিপের পরই রাস্তা বসে যায়- কখনো পরিবহন অযোগ্য হয়ে ওঠে। ঘ. রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার স্থিতিশীলতার অভাব। ঙ. শ্রমিকদের উস্কানিমূলক কাজে ব্যবহারের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান; বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি যার অধিকাংশই ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের প্রশ্রয়ে ঘটে থাকে। চ. বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব কর কাঠামোর অনুপস্থিতি। ছ. ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ও বিদেশি মূলধন স্থানান্তরের অবিশ্বাস্য জটিল প্রক্রিয়া। জ. ‘কারেন্সি সুইং’- মুদ্রার বাজার দরের চীনের তুলনায় অনেক বেশি ওঠানামা। ‘কারেন্সি সুইং’ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পথে বড় বাধা। ঝ. সরকার বদলের ঝুঁকি পড়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীর ওপরে। ঞ. ভারতের বাজার বড় হলেও ভোগের প্রশ্নে চীনের মতো সুষম নয়। চীনের ওপর বিদেশি উৎপাদনকারী যদি আস্থা হারায় সে তুলনায় ভারতের ওপর আস্থা রাখা যায়- এ কথা বলার সুযোগ নেই। বাধাগুলো বাংলাদেশেও প্রায় একই রকম। সুতরাং নাকের ডগা দিয়ে প্রত্যাহৃত কারখানা যদি ভিয়েতনাম চলে যায়, আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে পারি। আর গাইতে পারি, তুমি চলে গেলে- আমার বলার কিছু ছিল না।

সুখবর : জার্মান মালিকানাধীন ইউনাইটেড ব্রাইডাল ফ্যাক্টরি পোল্যান্ড ছেড়ে বাংলাদেশে আসছে। বিয়ের পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে এই কোম্পানির সুনাম আছে, কারখানা বসবে আদমজী ইপিজেডে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App