×

জাতীয়

অর্থনীতিতে সংকটের আভাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২০ এএম

অর্থনীতিতে সংকটের আভাস

অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব

করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে কাঁপছে বিশ্ব প্রাধান্য দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শঙ্কা

করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে ফের শঙ্কায় দেশের সার্বিক অর্থনীতি। দ্বিতীয় মেয়াদে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে আরো ভয়াবহ। ইউরোপ-আমেরিকায় ইতোমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। কোনো কোনো দেশে আবারো আরোপ করা হয়েছে লকডাউনের মতো কড়াকড়ি। এর সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ইতোমধ্যে ইউরোপের ক্রেতারা নেহায়েত প্রয়োজনের বাইরে নতুন করে অর্ডার দিচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেড়ে চলেছে সংক্রমণ। এই কারণে এসব দেশে আবারো লকডাউন করা হচ্ছে। এতে দেশীয় তৈরি পোশাকের বড় বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এই কারণে কমে গেছে রপ্তানি আদেশ। ইউরোপের ক্রেতারা এরইমধ্যে ক্রয়াদেশ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে পোশাক খাতের প্রায় ৩০ শতাংশ রপ্তানি আদেশ কমে গেছে। আমেরিকার বাজারেও একই অবস্থা। এছাড়া আরো উন্নয়ন সহযোগী দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ার কারণে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। করোনার প্রভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। দ্রুত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি আরো ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে বলে মনে করেন রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার সেকেন্ড ওয়েবের কারণে আমাদের যেসব উন্নয়ন সহযোগী দেশ ভুক্তভোগী, সেসব দেশে রপ্তানি কমে গেছে। অনেক দিন ধরে চলা বৈদেশিক বিনিয়োগে চলা স্থবিরতায় আরো বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ ঋণাত্মক হতে শুরু করেছে। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, করোনার সেকেন্ড ওয়েব আরো ভয়াবহ এবং দীর্ঘমেয়াদি হবে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতকে প্রাধান্য দেয়া। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে মাস্ক পড়া থেকে শুরু করে হাসপাতাল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ থেকে শুরু করে মানুষের কাছে সরবরাহ করা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকা। এসব স্থানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলায় কমে গেছে রপ্তানি আদেশ। চলতি অর্থবছরের অধেক অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রপ্তানি কমেছে প্রায় ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৯ সালের নভেম্বরের প্রথম ১৪ দিনে রপ্তানি হয়েছিল ১০৫ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পোশাক। চলতি নভেম্বরের একই সময়ে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্র বলছে, ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমার তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে পাওয়া ব্র্যান্ড ক্রেতাভিত্তিক কনটেইনার পরিবহন পরিসংখ্যানের। বড় ক্রেতাদের বেশিরভাগেরই রপ্তানি কনটেইনার পরিবহন কমেছে গত অক্টোবর মাসের প্রথম ৩ সপ্তাহে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এইচএন্ডএমের পণ্য পরিবহন করা টোয়েন্টি ফিট কনটেইনারের সংখ্যা ছিল ৮৬৩টি। এ সংখ্যা কমে দ্বিতীয় সপ্তাহে ৭৩০ ও তৃতীয় সপ্তাহে ৫৫০ এ নেমে এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিটওয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার প্রথম ধাপ কিছুটা কাটাতে পারলেও দ্বিতীয় ধাপ আরো ভয়াবহ হয়ে আসছে। এতে দেশ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়তে পারে। প্রতিটি দেশের সরকার এই করোনাকালে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে আসছে। এতে দেশগুলোর রিজার্ভে হাত পড়ছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে তাদের অর্থনীতি। রপ্তানির বড় বাজারগুলো করোনার কারণে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ইউরোপের ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া কোনো অর্ডার ইউরোপ থেকে আসছে না বলেও জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও করোনা আক্রান্ত হয়ে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৭ হাজার ৫৩১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সরকারি হিসাবে দেশে এখন পর্যন্ত মোট ৪ লাখ ৪১ হাজার ১৫৯ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৩০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭২২ জন।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সালানের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার সেকেন্ড ওয়েব মূলত অনুমাননির্ভর। আমরা আগেই বলেছি, শীতে করোনার প্রকোপ বাড়বে। গত দুই-আড়াই সপ্তাহ ধরে দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। এই সংক্রমণ কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নির্ভর করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনার ওপর। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রশাসনিক দৃষ্টিকোন থেকে বলব, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আগে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, সেকেন্ড ওয়েব নিয়ন্ত্রণে তার কোনো উন্নতি হয়নি। করোনা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ আগের জায়গাই আছে।

দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রথম ধাপে দুর্বল উত্তরণ ঘটেছিল। কিছুটা গতিশীল ছিল দেশের অর্থনীতি। করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ বড় ধরনের আঘাত হানবে অর্থনীতিতে। কৃষি উৎপাদনও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইতোমধ্যে রপ্তানি, ভোক্তা ব্যয় কমে গেছে। কৃষিতে কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও প্রবৃদ্ধিতে বড় আঘাত আসবে।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বিশ^ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার প্রথম ধাপ কিছুটা সামাল দেয়া গেলেও দ্বিতীয় ধাপটা আরো ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে অর্থনীতিতে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে বিদেশি বিনিয়োগে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ভ্রমণে কড়াকড়ি থাকায় এর সঙ্গে যুক্ত এয়ারলাইন্স থেকে শুরু করে মানি চেঞ্জারÑ এসব খাতে পড়বে বিরূপ প্রভাব। করোনার শুরু থেকে ভোক্তারা ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন। রপ্তানি বাণিজ্যে করোনার প্রভাব স্পষ্ট। তবে আশার আলো হচ্ছে আমাদের রেমিট্যান্স প্রতিনিয়ত রেকর্ড গড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, করোনার কারণে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় এসব বিদেশি অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। তবে করোনার দ্বিতীয় ধাপ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে, জানান এই অর্থনীতিবিদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App