×

সারাদেশ

বিরোধে জড়িয়ে জলদস্যুতায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:১৩ এএম

বিরোধে জড়িয়ে জলদস্যুতায়

প্রতীকী ছবি

ভালোই চলছিল মহেশখালীর কালামারছড়ার বাসিন্দা সহোদর আবু বকর সিদ্দিক ও আবদুর রশীদের জীবন। তবে মাত্র ৩ বছর আগে সম্পত্তিগত দ্বন্দ্ব নিয়ে হওয়া মামলাই কাল হয়ে আসে তাদের জীবনে। মামলার পর থেকেই নানারকম হয়রানি অতিষ্ঠ করে তোলে তাদের জীবন। এসব থেকে বাঁচতেই একসময় জলদস্যুতায় জড়িয়ে পড়েন ২ ভাই। তবে এবার স্থানীয়দের হয়রানির হাত থেকে মুক্তি মিললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পলাতক জীবনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। যে সম্পত্তি নিয়ে এ ঘটনা সেখানেই ফেরা অসম্ভব হয়ে ওঠে তাদের। পরে স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব জানতে পেরেই গত বৃহস্পতিবার র‌্যাবের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তারা। আত্মসমর্পণের সময় বোন মুবারাকা ইয়াসমিনের সঙ্গে ভোরের কাগজের কথা হলে উঠে আসে এসব তথ্য। শুধু এ ২ সহোদরই ৯ চট্টগ্রামের বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আসা ৩৪ জলদস্যুদের অধিকাংশ স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সম্পত্তি, রাজনৈতিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত শত্রæতা থেকে সৃষ্ট নানা ঝামেলা থেকেই জলদস্যুতার দিকে ধাবিত হন তাদের পরিবারের সদস্যরা। তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পত্তি, রাজনৈতিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত শত্রæতা শুধুই নয়; আসলে উপক‚লীয় অঞ্চলে সমতলের চেয়ে কাজের সুযোগ কম হওয়া একটি কারণ। তবে বিশাল সমুদ্রসীমা জয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের অন্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে কীভাবে ফেরত আসা দস্যুদের পুনর্বাসন করা যায় সরকারকেই তা ভাবতে হবে ও নিশ্চিত করতে হবে। নইলে এ কর্মকাণ্ড সফল বলে বিবেচনা করা সম্ভব হবে না। র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে উপক‚লবর্তী জলদস্যুরা। গত ২০১৮ সাল থেকে জলদস্যু সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ৫ শতাধিক জলদস্যু সন্ত্রাসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে প্রায় ৫ শতাধিক অস্ত্র সমর্পণ করে আত্মসমর্পণ করে। যা দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত সন্ত্রাসী অস্ত্রধারী উদ্দেশ্য আত্মসমর্পণের উল্লেখযোগ্য অংশ। সর্বশেষ গত ১২ নভেম্বর বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে র?্যাবের মাধ্যমে ৩৪ কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম সমুদ্র উপক‚লের ১২টি কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর ৩৪ জন জলদস্যু ৯০টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র, ২ হাজার ৫৬ রাউন্ড কার্তুজ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এ আত্মসমর্পণকে এতদাঞ্চলের মানুষ উপক‚লীয় এলাকায় সন্ত্রাস দমনে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে। জলদস্যুর আত্মসমর্পণের খবরে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপক‚লজুড়ে উপক‚লীয় এলাকার জেলে পল্লীগুলোতে স্বস্তি ফিরে এসেছে। র‌্যাব-৭ সূত্রে জানা গেছে, সাগরের ত্রাস বাইশ্যা ডাকাত বাহিনীর ৩ জন, খলিল বাহিনীর দুজন, রমিজ বাহিনীর ১ জন, বাদশা বাহিনীর ৩ জন, জিয়া বাহিনীর দুজন, কালাবদা বাহিনীর ৪ জন, ফুতুইক্যা বাহিনীর ৩ জন, বাদল বাহিনীর ১ জন, দিদার বাহিনীর ১ জন, কাদের বাহিনীর ১ জন, নাছির বাহিনীর ৩ জন ও আরো কয়েকটি বাহিনীর ১০ জনসহ মোট ৩৪ জলদস্যু বাঁশখালীর অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী শাহদাৎ হোসেন দোয়েলের স্ত্রী জুলেখা ভোরের কাগজকে জানান, গত ২০০৮ সালে বিয়ে হয় তার। তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে দুবাই প্রবাসী ছিলেন। তবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে তাদের ঝামেলা চলছিল অনেক আগ থেকেই। ৩-৪ বছর আগে দেশে ফিরলেই আবারো সেসব বিষয় নিয়ে ঝামেলা শুরু হলে জলদস্যুতায় জড়িয়ে পড়েন তার স্বামী। হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে তার স্বামীর বিরুদ্ধে বলেও জানান তিনি। এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক এ প্রতিবেদককে বলেন, আসলে শুধু আত্মসমর্পণের বিষয়টি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এরপরও আমরা দেখছি অনেকে আবার পেশায় ফিরে যাচ্ছেন। তাই আত্মসমর্পণের পর জলদস্যুদের সঠিক পুনর্বাসন ও সামাজিক বাধা উত্তরণের দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ জলদস্যুরা এক ধরনের সিগমায় ভোগে অর্থাৎ তাদের সমাজের মানুষরা অন্য চোখে দেখে থাকে। তাই স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পর তাদের সমাজ যেন স্বাভাবিকভাবে নেয় তার জন্য তাদের মর্যাদাপূর্ণ কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পরিবারের সদস্যরাও যেন হেয়-প্রতিপন্ন না হয় সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন সম্পত্তি, রাজনৈতিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত শত্রæতা শুধুই নয়; আসলে উপক‚লীয় অঞ্চলে সমতলের চেয়ে কাজের সুযোগ কম হওয়ায় একটি কারণ। বিশাল সমুদ্রসীমা জয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের অন্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে কীভাবে ফেরত আসা দস্যুদের পুনর্বাসন করা যায় সরকারকে তা ভাবতে হবে। নইলে এ কর্মকাণ্ড তেমন লাভজনক হবে না বলেও জানান তিনি। র‌্যাব-৭ এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) মশিউর রহমান জুয়েল বলেন, আসলে বিনাশর্তে ৩৪ জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন। এর মধ্যে হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়া অন্যান্য অপরাধের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের মামলা সহজেই শেষের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে হত্যা ও ধর্ষণের বিষয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যেতে হবে তাদের। এক প্রশ্নের উত্তরে সিও বলেন, গত ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রথম দফায় আলোচিত সাংবাদিক আকরাম হোসেনের মধ্যস্ততায় র‌্যাব-৭ এর সহায়তায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র‌্যাবের ডিজির উপস্থিতিতে মহেশখালীর আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ৫টি বাহিনীর ৪৩ জলদস্যু অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। আমরা পরে ৩৭ জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পেরেছি। তারা ভালো কাজ করেছেন। তবে ৬ জনের বিষয়ে জানা যায়নি। তবে তারা যদি পুরনো পেশায় কেউ ফিরে যায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, আত্মসমর্পণ যারা করছেন তাদের নানাভাবেই সহায়তা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র উপক‚লীয় এলাকায় কোনো জলদস্যু বা বনদস্যুর ঠাঁই হবে না বলেও জানান তিনি।    

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App