×

সাময়িকী

বিরল শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:১৮ পিএম

বিরল শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী

সুজন বড়ুয়া

আপাদমস্তকে গল্পের মানুষ তিনি। গল্প তার চোখে-মুখে, মগজের কোষে কোষে, শিরা-উপশিরায়। গল্প যেন তাকে ঘুমোতে দেয় না। মন খুলে গল্প শোনাতে পারলেই যেন তার শান্তি। গল্প বলেন মজা করে, রসিয়ে রসিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে। দারুণ তার গল্প বলার ভঙ্গি। যেমন তার কাহিনীর চমক, তেমনি বর্ণনার ঝলক। কথার চমৎকারিত্বে কখনও ঘোর লাগার জোগাড়, কখনও আবার হতবাক মানতে হয় বিস্ময়ে। বিষয়ে বুননে কথনে অত্যন্ত সপ্রতিভ আধুনিক গল্পের রূপকার তিনি। যদি তার গল্পের সঙ্গে লেখকের নাম নাও ছাপা হয়, তবু পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না, গল্পটি কার। এই স্বতন্ত্রধারার গল্প লেখকের নাম কাইজার চৌধুরী। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে অবিরল ধারায় লিখে চলেছেন তিনি। লিখছেন ছোটদের জন্য। কিন্তু কেবল ছোটরাই তার পাঠক নয়। তিনি সেই শিশুসাহিত্যের লেখক, যা সর্বজন পাঠ্য। তাই তার পাঠক-পরিধি বেশ বিস্তৃত। বিপুল পাঠক-নন্দিত লেখক তিনি। কাইজার চৌধুরী মূলত হাস্যরসের লেখক। যে কোনো বিষয় নিয়েই লিখুন না কেন, সরস উপস্থাপনার গুণে তার সব লেখায় হাস্যরসটাই প্রধান হয়ে ওঠে। তবে হাস্যরসের আড়ালে গল্পের মূল সুর-স্বাদ কখনও ঢাকা পড়ে না। বরং ভিন্ন মাত্রা পায়। এটি তার রচনার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তার এই ধারার পাঠকপ্রিয় বইগুলো হলো, ‘বিল্টুমামার হালচাল’ (১৯৯০), ‘বিল্টুমামার যত কাণ্ড’ (১৯৯২), ‘বিল্টুমামার আরেক কাণ্ড’ (২০১৪)। এসব লেখার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যে সৃষ্টি করেছেন বিল্টুমামা নামের মজার চরিত্রটি। কাইজার চৌধুরীর বিষয়-বৈচিত্র্য, ধরন-প্রকৃতি একেবারে তার নিজস্ব। নির্মল হাসির গল্প ছাড়াও তিনি প্রচুর মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখেছেন, লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই পর্বে তার বিশেষ আলোড়িত লেখা ‘শেমুর’ (১৯৯৫)। শেমুর মানে শেখ মুজিবুর রহমান। এটি রূপকথাধর্মী একটি বড়ো গল্প। বঙ্গবন্ধুর বীরগাথার মহাকাব্যিক রূপায়ণ। লেখকের বয়ানে একটু জানা যাক- ‘শেখ মুজিবুর রহমান!-কিশোরের গলায় বিস্ময়।-কী অদ্ভুত নাম! আমাদের কারু তো এমন ধরনের নাম রাখা হয় না মা! ওর বেলায় হলো কেন? ‘মা হেসে কয়, রাতদুপুরে কীসব প্রশ্ন করছ বাছা! তবে বলছি শোনো। যারা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে, যারা মানুষের জীবনে সুখ আনতে যেয়ে নিজে দুঃখ-কষ্ট সয়ে যায়, সেইসব লড়াকু মানুষদের আমরা শেখ মুজিবুর রহমান নমেই ডাকি।’ তিনি ভ‚তের গল্প লিখেছেন অসংখ্য। সেসব গল্পের আঙ্গিক অনুষঙ্গ আশ্চর্য আনকোরা। তার এই ধারার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো- ‘সপ্তভ‚তের সপ্তকাণ্ড’ (১৯৯১), ‘ভ‚ত চেনা সহজ নয়’ (১৯৯৩) ‘পুরোনো সেই ভ‚তের কথা’ (২০০০), ‘চোরের গল্প ভ‚তের গল্প’, ভ‚তের খোঁজে’ (২০০২) ইত্যাদি। ভ‚তের গল্প মানে ফ্যান্টাসির জগৎ। কিন্তু তার ভ‚তের গল্প নিছক ফ্যান্টাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, একইসঙ্গে নানা শিক্ষণীয় উপাদানে সমৃদ্ধ। অসামান্য কল্পনাশক্তির ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিময়। গোয়েন্দা ও রহস্য গল্পও তিনি লিখেছেন। যেমন, ‘গোয়েন্দা সাজল বিল্টুমামা’, (১৯৯২) ‘পরশ পাথর রহস্য’ (১৯৯৪)। ‘একাত্তরের রূপকথা’, ‘একাত্তরের ছেলেরা’, ‘শোভনের একাত্তর’, ‘ঘটেছিল একাত্তরে’ ইত্যাদি তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাড়া জাগানো গল্প-উপন্যাস। তার মুক্তিযুদ্ধের গল্পকথা হানাদার শত্রæবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদরের প্রতি তীর্যক ভাষ্যে অদ্ভুত ব্যঙ্গাত্মক আখ্যান। স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির প্রাচুর্যময় প্রাণের উল্লাস। কাইজার চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন যথাক্রমে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে। পেশাগত জীবনে ছিলেন খ্যাতিমান ব্যাংকার। এবি ব্যাংকসহ দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন সফলতার সঙ্গে। এই প্রাণবন্ত সুরসিক গল্পকার স্বভাবে ঈষৎ গম্ভীর, কিন্তু সামাজিকতায় অত্যন্ত আন্তরিক, বন্ধুবৎসল। মার্জিত রুচির হৃদয়বান এক মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। চেনা জানা মানুষের সমস্যা সংকটে তিনি সব সময় সাহায্য-সহযোগিতায় উদারহস্ত। শিশুসাহিত্য ছাড়াও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এবং লাতিন আমেরিকা ও প্রতিবাদী চলচ্চিত্র বিষয়ে তার মূল্যবান গবেষণা-প্রবন্ধ রয়েছে। তবে তার প্রধান সুখ্যাতি শিশুসাহিত্য রচনার জন্য। শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার, চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক এবং ছোটদের কাগজ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তবে একজন লেখকের প্রার্থিত যে পুরস্কার পাঠকের ভালোবাসা, সেটা তিনি অর্জন করেছেন অভ‚তপূর্ব মাত্রায়। আমাদের এক বিরল চরিত্রের বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী। গত ১৫ নভেম্বর ছিল তার ৭২তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রিয় শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী। আপনি দীর্ঘজীবী হোন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App