×

পুরনো খবর

নির্বাচনে জয়ই শেষ কথা নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৩৮ পিএম

এখন জো বাইডেনকে বিশাল এক সমস্যা সামনে রেখে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে হবে। একদিকে ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের বিরোধিতার মোকাবিলা করা এবং তা সামাল দেয়া, বিশেষ করে সিনেটে যদি ডেমোক্রেটরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারে। তখন পদে পদে তাদের কর্মযজ্ঞেও বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে, সেটা একটি বড় বিষয়। কাজেই জনহিতৈষী কর্মসূচি বাস্তবায়নেও বাইডেনকে পদে পদে ধাক্কা খেতে হবে।

জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে জয়ী হয়েও মনে হয় স্বস্তিতে নেই। প্রথমত নির্বাচনে লড়াইয়ে পরাজিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ফলাফল মানতে চাননি, যা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ঐতিহ্যে বড় একটা দেখা যায় না। তিনি অবশ্য পরাজয়ের সম্ভাবনা অনুমান করেই বলে চলেছিলেন, ফলাফল যাই হোক, তিনিই প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন।

মানুষ তার কথাবার্তা শুনে হেসেছে, মজা পেয়েছে। দ্বিতীয়ত ফলাফল ঘোষণার পর ট্রাম্পের দাবি- নির্বাচনে জালিয়াতি করা হয়েছে। এ ফলাফল সঠিক নয়। এর তদন্ত হওয়া দরকার। এবার ডেমোক্রেট শিবিরে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা। কারণ ট্রাম্পের চাতুর্যের তো তুলনা নেই।

নির্বাচনী প্রচারে এসব আশঙ্কা মাথায় রেখেই সম্ভবত বিচক্ষণ সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস জুটির পক্ষে প্রচারে মাঠে নেমেছিলেন যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে। তার ব্যাপক প্রচার দক্ষতা অনেকের চোখে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এখন অনেকে মনে করেন, বাইডেনের জয়ের পেছনে বারাক ওবামার নিশ্চিত অবদান রয়েছে।

আরো একটি বিষয় এ নির্বাচনে লক্ষ্য করার মতো যে আমেরিকায় প্রগতিশীল লবির বিশিষ্ট রাজনীতিক বার্নি সান্ডার্স মনোনয়নের পর্বে প্রতিদ্ব›দ্বী হওয়া সত্তে¡ও পরে বাইডেনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। কমলা হ্যারিসের কারণে বিশেষজনের ভোট বাইডেনের পক্ষে এসেছে। সম্ভবত ভারত-বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের নৈতিক সমর্থন ছিল ডেমোক্রেটদের পক্ষে।

তবু শঙ্কা ছিল, ভয় ছিল, শুধু শে^তাঙ্গ বর্ণবাদী ভোট নিয়েই নয়, ইলেকটোরাল কলেজ এবং ফ্লোরিডা ফ্রাক্টর নিয়ে- যে কারণে গত দুইবার নির্বাচনে ডোমোক্রেটরা হেরেছে। কারো কারো মতে, হারটা সঠিক ছিল না।

\দুই\

নির্বাচনে ভালোভাবে জেতার পর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অনিশ্চয়তাপর্ব মোটামুটি পার হবার পর ট্রাম্পের কঠিন সুর যখন কিছুটা নরম হতে শুরু করেছে, তখন বাইডেন মনে অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হবার আগে অন্যদের মতো তিনিও সব কিছু গোছগাছ করতে শুরু করেছেন।

যেমন কাকে কোন পদে বসাবেন, নতুন নতুন পরিকল্পনা ইত্যাদি। তবে শুভ দিক তার পক্ষ থেকে যে জয়ের পরপরই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি ‘সব আমেরিকানদের প্রেসিডেন্ট।’ অর্থাৎ বিভাজন নয়, ঐক্য। নির্বাচনের ফলাফলের পর প্রতিপক্ষ বলে কিছু নেই। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি সবাই আমেরিকান। সবার সমান অধিকার রাষ্ট্রের চোখে, বিচারালয়ের পক্ষে।

তিনি বিরোধী পক্ষকে একই বিবেচনায় রাখবেন। ঘোষণাটি অনেকের জন্য স্বস্তির কারণ হলেও ট্রাম্প গ্রুপ এবং রিপাবরিকানদের দিক থেকে বরফ গলার তেমন কোনো লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে না। কারণ ক্ষমতার স্বাদ বড়ই মধুর, হার সে পরিমাণ তিক্ত।

তাই এবার নির্বাচনোত্তর প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা অভাবিত বলা চলে। ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে নিলেও তারা নানাভাবে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। তাদের অঙ্গরাজের গভর্নরদের প্রতিক্রিয়াও মোটেই গণতান্ত্রিক চেতনার পরিচয় বহন করছে না। তারা এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদে তৎপর হচ্ছে।

একটি বাংলাদেশি দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম : ‘ভোট কারচুপির অভিযোগ’/‘বিকল্প প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় হচ্ছে ট্রাম্প সমর্থকরা।’ প্রযুক্তিগত যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বিরুদ্ধবাদী ফ্রন্ট তৈরি করতে শুরু করেছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রতিক্রিয়ার ভুবনে নতুন এক অভিনব ঘটনা, যা ট্রাম্প যুগের আগে কখনো দেখা যায়নি। এসবই ট্রাম্পের রাজনীতির অভিনব অবদান।

এজন্যই জয়ের পরও ডেমোক্রেট শিবিরে আনন্দ উল্লাসের পাশাপাশি অস্বস্তি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। হোয়াইট হাউসে আসন গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পানি কত ঘোলা হয় এবং তা কোন দিকে গড়ায় সে আশঙ্কা তাদের মনে প্রবল। এ প্রতিক্রিয়া যে বিভক্ত জনমানসকে স্পর্শ করছে না তাও নয়।

ট্রাম্প এবং তার সমর্থক গোষ্ঠী; এমনকি রিপাবলিকান দলের নেতৃত্বের বৃহদাংশ দেশকে, সমাজকে নির্বাচন উপলক্ষে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তা উদারপন্থি রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ চরম বিভক্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

কথাটা আমার নয়, সাবেক কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার। তার বিচক্ষণ অভিমত হলো ‘যুক্তরাষ্ট্র চরম বিভক্ত, এক নির্বাচনে ক্ষত সারবে না।’ জাতীয় পর্যায়ে এই বিভাজনের নায়ক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার নিকট ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। এর মধ্যে ইসরাইলি প্রভাব কতটা রয়েছে তা বিশেষভাবে হিসাব-নিকাশ করে দেখার মতো।

এর আগে একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম : সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্বাচনী ময়দানে এসে প্রচারে নামা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এবং পরিস্থিতির চাপে তাকে জো বাইডেনের পক্ষে মাঠে নামতে হয়েছে। এখন কথাটা স্বয়ং বারাক ওবামার কণ্ঠেই শোনা গেল : পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে নির্বাচনী ময়দানে নামতে, বাইডেন-কমলা জুটির পক্ষে প্রচারে।

অনেকের ধারণা, ডেমোক্রেটদের এ বিজয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান অবদান বারাক ওবামার। আমার ধারণা, অনুমান ভুল নয়। পূর্ববর্তী একটি কলামে আরো লিখেছিলাম, জো বাইডেনের এগিয়ে থাকা নিয়ে যত উল্লাস প্রকাশ করা হোক, ট্রাম্পের চাতুর্যের কারণে লড়াইটা হবে হাড্ডাহাড্ডি। বাস্তবে তাই ঘটেছে।

\তিন\

এখন জো বাইডেনকে বিশাল এক সমস্যা সামনে রেখে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে হবে। একদিকে ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের বিরোধিতার মোকাবিলা করা এবং তা সামাল দেয়া, বিশেষ করে সিনেটে যদি ডেমোক্রেটরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারে। তখন পদে পদে তাদের কর্মযজ্ঞেও বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে, সেটা একটি বড় বিষয়।

কাজেই জনহিতৈষী কর্মসূচি বাস্তবায়নেও বাইডেনকে পদে পদে ধাক্কা খেতে হবে। ট্রাম্পের গত মেয়াদের গৃহীত নেতিবাচক নীতি ও ব্যবস্থাগুলোকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে বাইডেনকে। ঘরোয়া কর্মসূচির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম ফিরিয়ে আনার কাজটাও হবে কঠিন- যেমন জলবায়ু সম্মেলন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নেতিবাচক জটিলতা।

কাজেই ডেমোক্রেট পার্টির জন্য সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন অপরিহার্য বিষয়। তা না হলে নির্বাচনে জয়ের মূল্য অর্ধেকেরও বেশি কমে যাবে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে প্রেসিডেন্টের অনেক ব্যতিক্রমী ক্ষমতা রয়েছে। নামেই গণতন্ত্রী দেশ। এর পরিচালনা নীতি অনেকটাই একনায়কী ধরনের।

সিনেটে গরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। স্মরণ করা যেতে পারে, বারাক ওবামার স্বাস্থ্যনীতির পরিণামের কথা। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিবাদী নীতি এবং ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান এমনকি হরেক রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে, ব্যর্থতার প্রভাব পড়বে পরবর্তী নির্বাচনে।

সে ক্ষেত্রে বার্নি সান্ডার্সদের ধীরপদ অগ্রসর যাত্রায় পিছুটান শক্তিমান হতে থাকবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিবাদী ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও পিছিয়ে পড়বে। এসব কারণে বাইডেন-মেয়াদ রাজনৈতিক বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ- শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, উদারনৈতিক-শান্তিবাদী বিশে^রও জন্য। মুশকিল, ডোমোক্রেটরা দলগত অন্দরমহলে পাথুরে ঐক্য গড়ে তুলতে কতটা পেরেছে তা অনেকের প্রশ্ন রয়েছে।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App