×

সাময়িকী

নারীর অন্তপুরের অব্যক্ত কণ্ঠস্বর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২০ পিএম

আশির দশক থেকে এই কবি কবিতা পথের পথিক। লিখে চলেছেন তিনি কবিতা। মাঝে মাঝে ছেদ চিহ্ন পড়েছে বটে, তবে তিনি কোনোদিন লেখা থামাননি। এ কথা জানা যে তার চলার পথ কোনোদিন মসৃণ ছিল না। জীবনের দুর্বিষহ ঘটনাগুলোকে, দারিদ্র্য, সামাজিক বিপর্যয়, দোষারোপ সবকিছু অসীম সাহসে অতিক্রম করে ফেরা এই কবি এখন তাঁর জীবনের মধ্যবয়সে থিতু হয়েছেন। কবিতা লেখার জন্য পেয়েছেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, জীবনের শুরুতে কবিতার জন্য পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘লা ফর্তিনা’ সম্মাননা। ২০১১ সালে মানিকগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদের কাছ থেকে পেয়েছেন আন্তরিক সম্মাননা। যে সম্মাননা তিনি নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের হাত থেকে গ্রহণ করেছিলেন। ২০১২ সালে কবিতার জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেন্ডশিপ সম্মাননা। কবিতায় তার নিজস্ব স্বর তাকে আর দশজন কবির থেকে আলাদা করতে পেরেছে। তার কবিতা বিদেশেও অনূদিত হয়ে কবি সমাজের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। মার্কিন কবি ক্যারোলাইন রাইট অনুবাদ করেছেন তার কবিতা। ভারতীয় বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তার অনেক কবিতার অনুবাদ করেছেন। ফলে বিদেশেও গড়ে উঠেছে তার কবিতার সমজদার। কবিতার জগতে বহুবর্ণিল কবিতার তিনি রচয়িতা। লিখেছেন তিনি ‘ভালোবাসার কবিতা’ (১৯৮২), ‘পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক’ (১৯৮৩), ‘প্রেমের কবিতা’ (১৯৯৮), ‘কে নেবে দায়’ (২০০১),‘খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান’ (২০১২), ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০০৬), এই বইটির বর্তমানে পঞ্চম সংস্করণ চলছে। এরপর তিনি লিখেছেন, ‘অবিনশ^র আয়না’ (২০১৮), লিখেছেন ‘নারী সংহিতা’ (২০১৯), সম্পাদনা করেছেন, ‘মুখোমুখি রফিক আজাদ’ (২০১৮), ‘গদ্যের গহন অরণ্যে, (২০১৯), লিখেছেন, ‘আনন্দ বেদনা যজ্ঞে রফিক আজাদ’, (২০১৮), ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, (২০২০), লিখেছেন শিশুতোষ রচনা, ‘সুষমার গল্প’ (২০১৯), এছাড়া তার কবিতা সমগ্র (২০২০), প্রকাশের অপেক্ষায়। তার অনবদ্য কবিতাগুলোর ভেতরে উঠে এসেছে সমাজ, সংস্কৃতি, পৌরাণিক মতবাদ, নারীর অধিকার ও সমাজে নারীর মূল্যায়ন। কারণ নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত হয়েও নারীরা হাজার বছর ধরে নির্বাক থেকেছে, যদিবা কখনো তার সবাক হবার চেষ্টা করেছে তো তাদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে, কেটে ফেলা হয়েছে জিহ্বা। অথবা দেওয়া হয়েছে তালাক। আর সে কারণেই কবি দিলারা হাফিজ তার ‘নারী সংহিতা’র উৎসর্গ পত্রে লিখেছেন ‘পৃথিবীর নিপীড়িত ও নির্যাতিত নারীর করকমলে যারা কথা ও কলমে কখনোই কোনো প্রতিবাদ করেননি।’ তার ‘কে নেবে দায়’ কবিতাগ্রন্থটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য সাহিত্যিক হোসেন উদ্দিন হোসেন। সেখানে তিনি এই কবিকে কবিতার জগতে জানিয়েছিলেন সাদর সম্ভাষণ। নতুন এক দিগন্তের উন্মোচনের রূপরেখা ছিল তার কবিতায়। দিলারা হাফিজের কবিতায় নারী কণ্ঠস্বরের উপস্থাপনা বড় সুচারুভাবে উপস্থিত হয় তার ‘নারী সংহিতা’ গ্রন্থে। নারীর জন্ম থেকে কিশোরী হয়ে ওঠা এবং কিশোরী থেকে মেয়ে হয়ে ওঠা এবং পরিশেষে মানুষ হয়ে ওঠার গল্প আছে তার ‘নারী সংহিতা’ কবিতা গ্রন্থে। যেমনÑ ‘‘আম-বাগানের নির্জনতার মুখে একাকিনী কিশোরী আজ ভুলে বুকের ওপর হাত রেখেছে যেই ধূপছায়া বুক আগের মতো নেই একি! পাথার সোনা-দানা! লজ্জা ভয়ে বাড়লো বিভাবনা বিপুল বিজন ওড়না আড়াল বুকে শস্য-আঁকা দীর্ঘ দুটি চোখে দীপ্র শরীর চমকে ওঠে রাতে কিশোরী আজ জেগে ওঠে নারীর নহবতে।’’ কবি দিলারা হাফিজের আরও কৃতিত্ব এই যে তিনি তার সমাজের নারীর অন্তপুরের অব্যক্ত কণ্ঠস্বরগুলোকে কাব্য ভাষায় রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। উচ্চারণ করতে পেরেছেন নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি। সাহসের সঙ্গে বলতে পেরেছেন, ‘‘আমি জানি আমাকে ছাড়া পৃথিবী এগোবে না এক পা।’ কবি দিলারা হাফিজের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগঞ্জের গড়পাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম বখশী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, মা রহিমা হাফিজ। ছেলেবেলা থেকেই তার ছিল সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। স্কুলের ম্যাগাজিনে এবং দেয়াল পত্রিকায় তিনি লিখতেন। কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। হাসিখুশি এবং লাজুক স্বভাবের হলেও সকলে তাকে খুব পছন্দ করত। বাবা ছিলেন তার জীবনে অনুপ্রেরণা। মা দিতেন তাকে সাহস। সাহসী ছিলেন দিলারা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি যখন তার ছেলেবেলার কথা লেখেন তার ভেতরেই প্রকাশ পেয়ে যায় তার ভেতরের কবি মনের এক সম্ভাবনা। ছেলেবেলা থেকে কবিতা লিখতেন। এবং সেসব কবিতা স্থানীয় ম্যাগাজিনে ছাপানো হতো। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগই তাকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স পড়তে অনুপ্রাণিত করে। ছাত্রজীবনেই তিনি ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। এবং এককালে এই কবিতার চর্চাকালেই কবি রফিক আজাদের সঙ্গে তার আলাপ এবং পরবর্তীতে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স ও এমএ করেন এবং পরবর্তীতে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এরপর ১৯৯৮ সালে তিনি অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। যার বিষয়বস্তু ছিল, ‘বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ’। বইটি পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমি থেকে বের হয়। লেখার পাশাপাশি তিনি সরকারি চাকরি করেছেন, সংসার প্রতিপালন করেছেন, পিএইডি করেছেন, ছেলেদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং কবি রফিক আজাদকেও যত্নে রাখবার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন। এবং এসবের পাশাপাশি কবিতা লিখে গেছেন। এসব অলিখিত ইতিহাস কখনো বা কোনোদিন হয়তো লেখা হবে। ব্যক্তিগত জীবনে যদিও তিনি ছিলেন কবি রফিক আজাদের ঘরণী কিন্তু মহান সেই কবির ছত্রছায়ার নিচে তিনি নিজেকে আবৃত করে ফেলেননি। যা করা খুব স্বাভাবিক ছিল। কারণ বটগাছের নিচে চারাগাছ মাথা তুলতে পারে না। না, তিনি সেটা হতে দেননি। নিজের স্বকীয় মেধায় কবিতার রাজ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ তার আছে সেইসব ভয়াল অভিজ্ঞতা, সেই ভাঙচুরের ভেতরে গড়ে তোলা সোনার তোরণ যা তাকে কবিতার রাজ্যে নিজস্ব ভাষা ও ভাবের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তিনি যখন লেখেন, বহু ঝড় জলোচ্ছ্বাস আর অগ্নি মাড়িয়ে আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি একা; সম্পূর্ণ একলা নৈঃসঙ্গ ছাড়া কোনো বন্ধু ছিল না আমার করতলে হাত রেখে গোপন কোনো বেদনা জানাতে পারি অকপটে এরকম কোনো বন্ধু কখনো ছিল না অতিক্রান্ত এই দীর্ঘ যাত্রায়; (প্রকাশিতব্য) আজ কবির জন্মদিন। তাকে আমাদের সশ্রদ্ধ ভালোবাসায় জন্মদিনের প্রাণরক্তিম শুভেচ্ছা জানাই। শুভ ও সার্থক হোক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App