×

জাতীয়

তিন কারণে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৩৩ এএম

তিন কারণে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা

থামছে না রেল দুর্ঘটনা। চলতি নভেম্বর মাসেই রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে ৭টি ট্র্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ জন, আহত অর্ধশতাধিক। আর চলতি বছরে অর্ধশতাধিক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেল পরিসংখ্যান বলছে বিগত ১০ বছরে অর্থাৎ রেলকে আলাদা মন্ত্রণালয় ঘোষণার পরে প্রায় ৪ শতাধিক রেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩ শতাধিক মানুষ। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ের কারণে ঘটেছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হচ্ছে তার ৮৯ শতাংশই ঘটছে অরক্ষিত ক্রসিংয়ের কারণে। সারাদেশে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার রেলপথে লেভেলক্রসিং রয়েছে ২ হাজার ৫৪১টি। যার মধ্যে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১৪০০, অননুমোদিত ক্রসিং ১১৪১, আর গেট ম্যান আছে মাত্র ৪৬৬টিতে। বাকি ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান না থাকায় এসব স্থান মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে।

রেলযাত্রীরা বলেছেন, সবচেয়ে নিরাপদ যাত্রা হিসেবে পরিচিত রেলপথেও দুর্ঘটনা থামছে না। দীর্ঘদিন আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতির সময়ে রেল দুর্ঘটনা যেসব কারণে ঘটেছে এখনোও একই কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। হাজার কোটি টাকা খরচের পরও রেলপথ নিরাপদ হয়নি, রেলযাত্রাও এখন অন্য যাত্রার মতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রেল দুর্ঘটনা এড়াতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রেল লাইনগুলো নিয়মিত মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা। কিন্তু তা হচ্ছে না। দেশের মাত্র ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার রেলপথ সংরক্ষণ করাই রেলের কাছে দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। আর মাত্র ৩ থেকে সাড়ে ৩ শত ট্রেন চালাতেই যদি রেল এত দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তবে রেলের উন্নয়ন কোথায় ঘটল এমন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের। অথচ গত ১০ বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় শতাধিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেক প্রকল্প শেষ হয়েছে। অর্ধেক প্রকল্প চলমান। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয়নি। চলছে পদ্মা লিংক রেল প্রকল্প, দোহাজারী কক্সবাজারের মতো মেগা প্রকল্প। কিন্তু রেল যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়েছে। বাড়েনি সেবার মান।

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক মনে করেন, বর্তমান রেলওয়েতে উন্নয়নের নামে প্রচুর অর্থ

বরাদ্দ বা ঋণ নিয়ে খরচ করা হচ্ছে। এগুলো সবই নতুন প্রকল্পের জন্য ব্যয় হচ্ছে। রেলের নিজস্ব অবকাঠামো উন্নয়ন বা সংশ্লিষ্ট রেল লাইন, রেলের বহু পুরাতন ব্রিজ বা কালভার্ট মেরামত, পুরাতন সিগনালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। কিন্তু সেদিকে নজর না দিয়ে রেল একের পর এক নতুন প্রকল্প নিচ্ছে। সেই সঙ্গে রেলের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেবার আহ্বান জানান তিনি।

রেল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মান্ধাতার আমলের রেল লাইন মেরামত করার মতো লোকবল থাকলেও নিয়মিত মনিটরিং নেই। নেই কোনো কর্মী বা কর্মকর্তার দায়বদ্ধতা। তাছাড়া পুরাতন এসব রেল লাইনের নিচে মাটি সরে গেছে। নেই পাথর। তাছাড়া কংক্রিটের স্লিপারের পরিবর্তে এখনো কোথাও কোথাও রয়ে গেছে কাঠের পুরাতন স্লিপার। যার জন্য রেল পার্টি সরে যাচ্ছে, ঘটছে দুর্ঘটনা। সেই সঙ্গে দায়িত্বহীনতা রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তারা।

রেলসূত্রে জানা গেছে ৭০ শতাংশ মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হচ্ছে ট্রেন, বগির সংকট কাটাতে পুরাতন বড়ি জোড়াতালি দিয়ে রেল বহরে জোড়া হচ্ছে, যার ব্রেক বাধা জিআই তার দিয়ে কোনোভাবে জোড়াতালি দিয়ে। এছাড়া এক বগির চাকা অন্য বগিতে লাগানো, অন্য বগির ব্রেক আরেক বগিতে লাগানো, এসব এখন রেলে নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর মালবাহী ওয়াগনগুলোর ইঞ্জিনের অবস্থা আরো খারাপ। যার জন্য মাসে গড়ে ৫-৭টি দুর্ঘটনা এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে রেলের এডিজি অপারেশন মিয়া জাহান বলেন, দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। এটা কখন ঘটবে তা বলা যায় না। তবে আমাদের লাইনের কিছু ত্রæটি রয়েছে, সেগুলো মেরামত করা প্রয়োজন। আবার বেশি দুর্ঘটনার কারণ অরক্ষিত লেভেলক্রসিং। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দ্রæত কর্মী নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করছি।

রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান জানান, দুর্ঘটনা কখন ঘটবে তা বলা যায় না। তবে আমরা রেলের সংস্কারের কাজ করছি, প্রতিটি কর্মীর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য চালক, গার্ড সিগনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে। তবে কর্মী স্বল্পতা রয়েছে, কর্মী সংকট দ্রæত কেটে গেলে রেলে দুর্ঘটনা কমবে।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, মূলত দ্রুতগতিতে ট্রেন চালানো, সিগনাল না মেনে ট্রেন চালানো, গার্ড ও ড্রাইভারের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা রয়েছে। তাছাড়া কিছু পুরাতন লাইন ও বগি ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের কর্মীসংখ্যা কম থাকায় আমরা নিয়মিত লাইন মেরামতসহ রেলের সব ধরনের সেবা পরোপুরি দিতে পারছি না। রেলের ৪৭ হাজার কর্মীর চাহিদা থাকলেও আছে মাত্র ২৫ হাজারের মতো। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কর্মী নিয়োগ দেয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কর্মী নিয়োগ হলে রেল দুর্ঘটনা কমবে এবং সেবার মান বাড়বে।

তিনি জানান, রেলের অনুমতি না নিয়ে অনেক সংস্থা এমনকি নিজস্ব প্রয়োজনে রেল লাইনের ওপর দিয়ে ক্রসিং বা পথ তৈরি করেছেন অনেকে। এগুলো নিয়ে আমরা মামলাও করেছি। আবার দেশের বৈধ ক্রসিংগুলোতে কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া বিদেশ ইঞ্জিন এবং বগি আনার জন্য চুক্তি হয়েছে। এগুলো এসে গেলে রেলের প্রভ‚ত উন্নয়ন ঘটবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App