×

পুরনো খবর

ট্যাক্স দেব, ভোট দেব বিনিময়ে কী পাব?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৪৬ পিএম

বাংলাদেশের মানুষ ইতোমধ্যে প্রায় ৫০টি বছর পার করে দিল। এরপর করোনা মহামারি এসে আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দিল, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমরা কতটা অসহায়। স্বাস্থ্য নিয়ে শুধু নয়, সমাজের সবকিছু নিয়ে এটুকু বুঝা গেল, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের দ্বারপ্রান্তে আসতে পারেনি। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের খাদ্য অধিদপ্তর ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের প্রধান তার আবেগঘন বক্তব্যে জানিয়েছেন, ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ আসছে পৃথিবীতে।

নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচন কমিশন জোরেশোরে প্রচার করে- আপনার ভোট, আপনার অধিকার; ভোট দিন, অধিকার বুঝে নিন। মানুষ কথা শুনেন, ভোট দেন। অন্তত ভোট দেয়ার প্রস্তুতি নেন। ভোট দেয়ার পরিবেশ না থাকলে কিংবা বাধাপ্রাপ্ত হলে তা অবশ্য ভিন্ন কথা। তবে ট্যাক্স সবাই দেন না। ট্যাক্স আইনে যাদের দেয়ার কথা, তারা দেন। বাকিদের দিতে হয় না। অথবা ট্যাক্স দেয়ার কথা থাকলেও কেউ কেউ ফাঁকি দেন। তবে অধিকাংশই ট্যাক্স দেন। রাষ্ট্র বলছে- ভোট দাও, ট্যাক্স দাও। রাষ্ট্রের মানুষ সে কথা শুনছেন, তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে যে মানুষটি সারাজীবন ভোট এবং আয়কর দুই-ই দিয়ে এসেছেন- করোনা যুদ্ধের সময় আর্থিক মন্দার কারণে যখন তার চাকরিটা চলে গেল, তখন রাষ্ট্র কী করছে? যে ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা চরম সমস্যার মধ্যে পড়েছে, অথচ এক বছর আগেও নিয়মিত ভ্যাট জমা দিয়েছেন সরকারের ঘরে, এখন রাষ্ট্র তার জন্য কী করছে? কিছু মানুষের শুধু করোনা চিন্তা থাকলেও অধিকাংশ মানুষের করোনার পাশাপাশি আর্থিক চিন্তাও বড় করে দেখা দিচ্ছে। কারো কারো কাছে করোনা দ্বিতীয় স্তরে, আর্থিক চিন্তাই প্রথম স্তরের চিন্তা। করোনা হলে হাসপাতালে যাবে কী করে, হাসপাতালের বিল দেবে কীভাবে কিংবা ওই সময়ে সংসার চালাবে কীভাবে- এমন ভাবনার পাশে ওই মানুষটি তার পরিবার ছাড়া আর কাউকে কি পাশে পাচ্ছে? যে মানুষটি গত আর্থিক বছরেও সরকারের ঘরে ট্যাক্স দিয়ে এসেছেন, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন- সেই মানুষটিকেই দেখা গেল করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। কোথাও ভর্তির সুযোগ হচ্ছে না। এটি শুধু যে বাংলাদেশের চিত্র তা নয়। একই চিত্র দেখেছি ভারত ও পাকিস্তানেও। এই চিত্র কি কখনো দেখা গিয়েছে কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা অন্য কোনো উন্নত দেশে? না, যায়নি। কেননা সেখানে রাষ্ট্র এই দুর্যোগের সময় সব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সংকটকালে মানুষের সবচেয়ে যা প্রয়োজন, সেই নগদ অর্থ পৌঁছে দিয়েছে এই রাষ্ট্রগুলো তাদের মানুষদের হাতে। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী কেউ বাদ পড়েনি তা থেকে। ব্যবসায়ীকে কর্মচারী ছাঁটাই না করার শর্তে প্রণোদনা নগদ অর্থে দিয়েছে, ব্যবসায়ীকে ঋণ দিয়েছে সহজ শর্তে, চাকরিচ্যুতদের প্রতি মাসে নগদ অর্থ তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দিয়েছে। সেখানে ভোট আর ট্যাক্স দেয়া মানুষগুলো বিপদের সময় রাষ্ট্রের আর্থিক সাহায্য পাচ্ছেন। আর বাংলাদেশের মানুষ কী পাচ্ছেন? তারা চাকরি হারাচ্ছেন, ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন, কম খেয়ে কিংবা না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। রাষ্ট্র আমাদের নাগরিক হিসেবে কতটা সম্মান দেয়? কতটা ভাবে আমাদের কথা? ভিড়ে ঠাসা বাস, ভিড়ে ঠাসা ট্রেন, বিপজ্জনক সড়ক যাত্রা, রান্নার গ্যাসের সাপ্লাই ঠিক সময়মতো হবে কিনা, চাকরিটা পরের দিনও থাকবে কিনা এমন নিরন্তন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জীবন-যাপনের মধ্যে সম্মান কোথায়? আমাদের জীবনযাত্রার এই চেনা ছক বদলাচ্ছে না কেন? কারণ রাষ্ট্র আমজনতার ব্যক্তিগত জীবন অথবা সম্মান নিয়ে ভাবছে না। দেশবাসী রাষ্ট্রকে সবসময় সাহায্য করছেন, সব কথা মেনে চলছেন, প্রতিটি নির্দেশের সম্মান করছেন। বিনিময়ে সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক প্রয়োজনগুলো চেয়ে এসেছেন- জীবিকার নিশ্চয়তা, জীবনের নিশ্চয়তা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা, শিক্ষার নিশ্চয়তা, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। বিশ্ব মহামারিতে পড়ে আজ সাধারণ মানুষের কাছে নতুন প্রশ্ন হয়ে এসেছে- রাষ্ট্র এই মৌলিক প্রয়োজনের কতটুকু মানুষের জন্য নিশ্চিত করতে পেরেছে? হঠাৎ আসা একটি মহামারি এবার প্রমাণ করে দিল যে, বহু দল ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু গত ৫০ বছর পর এই ন্যূনতম চাহিদাগুলো নিয়েই এখনো মানুষ চিন্তিত। আমাদের ভাগ্যের চাকাটি স্বাধীনতার পূর্বে আরো বেশি করে শুধু হতাশার সুতা বুনিয়েই ঘুরে গিয়েছে। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান কোনো আমলই সাধারণ মানুষের জন্য সুখকর ছিল না। শাসন নয়, শোষণই ছিল তখনকার রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলমন্ত্র। তা আমরা হয়তো পার করে এসেছি। কিন্তু মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে এখনো আমরা সক্ষম হতে পারিনি। ব্রিটিশদের লুটপাটের কথা কারো অজানা নয়। ২০০ বছর ধরে তারা শুধু ভারতবর্ষকে শোষণ করেই গেছে। এ কথা ঠিক, আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে রাজনৈতিক ঐক্য ও গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রেল যোগাযোগ, ইংরেজি শিক্ষা, এমনকি চা এবং ক্রিকেটও লাভ করেছি। কিন্তু ১৭৫৭ পরবর্তী বছরগুলোতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতিও আমরা লাভ করেছি। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে একটি দ্বন্দ্ব ও বিবাদের প্রাচীর গড়ে তোলাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নীতি। তাদের এই ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি চরম শিখরে পৌঁছায় ১৯৪৭ সালে, যখন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। দেশভাগের পর ১০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দেশান্তরী হয়। কয়েক বিলিয়ন টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়। ক্ষত-বিক্ষত এক ভূমিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। এরপর ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, তখনো মানুষের মৃত্যুর মিছিল লক্ষ্য করেছে পৃথিবীর মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে ব্রিটিশ শাসনে, পাকিস্তান শাসনে। এ দেশের মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে কখনো সচেষ্ট হননি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি। সেই দুঃস্বপ্ন পার হয়ে একদিন নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। ছিনিয়ে এনেছে নিজেদের স্বাধীনতা। আর মনে মনে ভেবেছে- এই আসবে আমাদের সুখের সময়; রাষ্ট্র পূরণ করবে মানুষের ন্যূনতম চাহিদাটুকু। আশায় বুক বেঁধেছে, আর বছরের পর বছর পার হয়েছে। সরকার এসেছে, নেতা এসেছেন; সরকার বদলেছে, নেতা বদলেছেন; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। ভোট চাওয়া ও ভোট পাওয়ার প্যাটার্নটা বদলে যাচ্ছে হয়তো। অনেক বেশি বেশি করে আজকাল বিভাজিত করে দেয়া হচ্ছে সমাজকে। মানুষ ফাঁদে পা দিয়েছে। রাজনীতি ও সামাজিক বিভাজনের ইস্যুতে অংশ নিতে শুরু করেছে। এর ফলে জাতিগতভাবে বাঙালি শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। যতই বিভাজিত হচ্ছে, সামগ্রিক বাঙালির স্বার্থের ইস্যুতে ততটাই একজোট হতে পিছিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ক্রমেই সম্মিলিত ভাবনার পরিবর্তে পৃথক পৃথক দ্বীপ তৈরি হয়ে যাচ্ছে সমাজে। ফলে রাষ্ট্রও আমাদের কথা ভাবনা থেকে মুছে ফেলার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। কেননা আমরা তো একজোট হয়ে আমাদের কথা বলতে পারছি না। তাই আজকের সবচেয়ে বড় চিন্তার জায়গাগুলো যেমন সংক্রমণ, লকডাউন, অসংখ্য জীবিকার সর্বনাশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন রোজগারের সম্ভাবনা, পড়াশোনার ভবিষ্যৎ, চাকরির ভবিষ্যৎ এসব জ্বলন্ত ইস্যুকে আমরা সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে দেখছি না রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র নিশ্চয়ই সব মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে পারবে না। মানুষের নিজেরই দায়িত্ব সেটা। কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের চরম প্রয়োজনের সময় পাশে দাঁড়াবে- এটুকু একেবারেই ন্যূনতম চাহিদার মধ্যে পড়ে। আর মানুষের মুখে যেন অন্ন জুটে তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থাটি রাষ্ট্র করে দেবে। এটুকু চাহিদা তো রাষ্ট্রের বাধ্যগত নাগরিকরা করতেই পারেন। এই চাহিদার থালা হাতে বাংলাদেশের মানুষ ইতোমধ্যে প্রায় ৫০টি বছর পার করে দিল। এরপর করোনা মহামারি এসে আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দিল, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমরা কতটা অসহায়। স্বাস্থ্য নিয়ে শুধু নয়, সমাজের সবকিছু নিয়ে এটুকু বুঝা গেল, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের দ্বারপ্রান্তে আসতে পারেনি। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের খাদ্য অধিদপ্তর ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের প্রধান তার আবেগঘন বক্তব্যে জানিয়েছেন, ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ আসছে পৃথিবীতে। চরম খাদ্যসংকট দেখা দেবে বিশ্বে। ক্ষুধায় মরতে পারে কোটি মানুষ। অবিলম্বে সাহায্যের হাত না বাড়ালে অন্তত ৩ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে স্রেফ না খেতে পেয়ে। কিন্তু আমাদের কি সেদিকে ততটা মাথাব্যথা আছে? মানুষের বাঁচার কথা, খাওয়ার কথা, শিক্ষার কথা, চিকিৎসার নিশ্চয়তার কথাÑ এসব যেন আলোচনার অভিধান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তবে প্রগতির ধারাটি ঠিক কোথায়?

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App