×

জাতীয়

জুয়াড়িদের চোখ অনলাইনে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ১২:৩৬ পিএম

জুয়াড়িদের চোখ অনলাইনে
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাসিনো-জুয়ার আসরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যেও অনলাইনে রমরমা জুয়া খেলা চলছে। ধনাঢ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরাও এতে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। র‌্যাব ও পুলিশের লাগাতার অভিযানে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বন্ধ হওয়ার পর জুয়াড়িদের চোখ এখন অনলাইনে। যার আরেক নাম বেটিং। তিনপাত্তি গোল্ড নামে এক ধরনের অনলাইন জুয়ায় ডুবে আছে কয়েক লাখ যুবক ও তরুণ। এটি খেলার জন্য কথিত ‘চিপস’ দরকার হয়। এর মূল অফিস ভারতে। দুনিয়াজুড়ে রয়েছে এর এজেন্ট। বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে এর চিপস বেচাকেনা হয়। ঢাকায় এই কাজে লেনদেন হয় এমন কয়েকজনকে চিহ্নিত করে নোটিস করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াড। তাদের পর্যায়ক্রমে সিআইডি সদর দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে তাদের ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধান চলছে বলে জানা গেছে। এদিকে, চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ১৭৬টি জুয়ার সাইটের গেটওয়ে বন্ধ করে দেয়; তবুও ‘তিন পাত্তি গোল্ডের’ মতো আরো ২-১টি সাইটে জুয়া খেলা চলছে। বিটিআরসি বলছে, অনলাইনে খেলা হয় এমন জুয়া নিয়ন্ত্রণে আনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি সংস্থার পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য। এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিক্তিতে আগে ১৭৬টি সাইট বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এরপরও যদি আরো কোনো সাইটে অনলাইন জুয়া চলে তবে সুনির্দিষ্টভাবে এর তথ্য পেলে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ নেয়া হবে। সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্থপাচার হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। অনলাইন জুয়ার আসক্ত এমন কয়েকজনের মানিলন্ডারিংয়ের ক্লু পাওয়ায় তাদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। জানা গেছে, ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিবন্ধিত বেটিং সাইটগুলোতেই মূলত বাংলাদেশিদের পদচারণা। নানা ধরনের জুয়া খেলার পাশাপাশি এগুলোতে আছে বাজি (বেটিং) ধরার ব্যবস্থাও। এ সাইটগুলোতে ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি ম্যাচ চলাকালে লাইভ বাজি ধরার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া যেসব ম্যাচ কোনো চ্যানেলে সম্প্রচার হয় না সেই ক্লাবের খেলা নিয়েও হয় বাজি। অনলাইন ‘বাজিকর’-দের বেশির ভাগই শিক্ষিত শ্রেণির। অনলাইনে বাজি ধরা হয় ডলারে এবং এজন্য প্রয়োজন ক্রেডিট কার্ড। অনলাইন জুয়ায় জড়িত এমন কয়েকজন জানিয়েছেন, প্রথমে এসব সাইটে জুয়াড়িদের অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়। জুয়ায় অংশ নিতে অর্থ পরিশোধ করতে হয় ক্রেডিট কার্ডে। যাদের ক্রেডিট কার্ড নেই অথবা যেসব সাইটে বাংলাদেশ থেকে নিবন্ধন করা যায় না সেখানেও আছে বিকল্প ব্যবস্থা। দেশে এসব জুয়ার সাইট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ‘এজেন্ট’। তারাই অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া এবং অর্থ পরিশোধের কাজটি করে দেয়। টাকার বিনিময়ে তারা ডলার কিনে নেয় জুয়াড়িদের কাছ থেকে। আর হুন্ডির মাধ্যমে এসব ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইপিএল খেলায় দেশে কয়েক কোটি টাকার জুয়া হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কয়েক হাজার মানুষ কোনো বলে কতো রান বা কী হবে এ নিয়ে বাজি ধরে টাকা খুইয়েছেন। এ তালিকায় রিকশাচালক থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত যুবকরা রয়েছেন। দেশের কয়েকটি এলাকার যুবক এবং তরুণদের মূল কাজই এখন অনলাইন জুয়া! তিনপাত্তি গোল্ড নামে অনলাইন জুয়া আসক্ত একাধিক যুবকের ব্যাপারে খোঁজ করে জানা গেছে, তিন পাত্তি গোল্ড হচ্ছে ৩টি তাসের খেলা। খেলার সবচেয়ে বড় কার্ড হলো ৩ টেক্কা আর সবনিম্ন কার্ড ২-৩-৫। এ গেমের মূল বস্তুটি হচ্ছে চিপস বা কয়েন। এর সঙ্গে যুক্তদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নামে-বেনামে একাধিক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। নিজের পরিবারে নাবালক সদস্যদের নামেও রয়েছে অ্যাকাউন্ট। এরমধ্যে রয়েছে ফেক আইডি। রাতভর তারা মোবাইল ফোনে এই খেলায় অংশ নেয়। একজন ৪-৫টি মোবাইল ফোন নিয়ে বসে। এই খেলার ‘এক কোটি চিপস (পয়েন্ট)’ ৭০-১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এই চক্রের অনেকের এতে প্রতিরাতে আয় ৩-৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলে অনেকের পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস্য চিপস ব্যবসা! অনলাইনে সার্চ দিলে শত শত চিপস ডিলার পাওয়া যায়। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মিনি এজেন্ট নেয়া যায়। ইউটিউব, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘিরেই এ ব্যবসা জমজমাট। জানা গেছে, সম্প্রতি অনলাইনে ভারতের শিলং থেকে পরিচালিত ‘তীর কাউন্টার ডটকম’ ও ‘তিন পাত্তি গোল্ড ইন’ বেশি জনপ্রিয়। এর মধ্যে ‘তীর কাউন্টার’ বেশি পছন্দ সিলেট অঞ্চলের জুয়াড়িদের। আর ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ মোটামুটি পুরো দেশ থেকেই কম-বেশি খেলা হয়। আর বেটিং সাইটগুলোর মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ‘বেট ৩৬৫’। ঢাকার বারিধারা এলাকার বাসিন্দা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব (ছদ্মনাম) জানান, তিনি এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে বেট ৩৬৫-এর মাধ্যমে ক্রিকেট ক্লাবের ফুটবলে ডলারে বাজি ধরেন। বিদেশে তাদের অফিস আছে। এজেন্টরা সেখান থেকে অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়, এর জন্য একটা ফি জমা দিতে হয়। জিতলে এক বড় ভাইয়ের কাছে ডলার একটু কম দামে বিক্রি করেন। সূত্রমতে, রাজধানীর গুলশান ও নেত্রকোনা থেকে অনলাইন জুয়ার বাংলাদেশি মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তাকৃতরা হলেন মো. শামীম মিয়া (৩০), আবদুল আলি (৩১), এরশাদ মিয়া (২৯) ও সোহাগ মিয়া (২৭)। এছাড়া কয়েকজনকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে জুয়ার কাজে ব্যবহৃত ৬টি মোবাইল, একটি রেজিস্ট্রার খাতা, ১-৯৯ পর্যন্ত নম্বর বিশিষ্ট চারটি চার্ট সংবলিত ব্যবহৃত শীট এবং ৫টি অব্যবহৃত চার্ট সংবলিত শিট জব্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে অনলাইনে জুয়া খেলার টাকা ভারতের শিলংয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে অনলাইন জুয়ার আসরের বর্ণনা দিয়েছে গ্রেপ্তারকৃতরা। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা বলেছেন, অনলাইন জুয়ার ফাঁদে ফেলে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। জুয়াড়ি, সেলসম্যান ও এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এই জুয়া। সারাদেশেই ‘তীর টুডে ডটকম’-এর এজেন্ট ও সেলসম্যান রয়েছে। ভারতের শিলং থেকে এ জুয়া পরিচালিত হয়। ভারতের শিলংয়ে দেয়া হয় ৭০ গুণ লাভ। আর বাংলাদেশে দেয়া হয় ৮০ গুণ লাভ। একজনের একাধিক সংখ্যাও কেনার সুযোগ রয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে চলছে এই জুয়া খেলা। দিনমজুর, ট্রলি ড্রাইভার, কয়লা শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীসহ স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে জুয়ার এজেন্টরা। চক্রটি প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিজয়ীরা লাভবান হলেও অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। জুয়া খেলার মাধ্যমে অর্জিত টাকা অনলাইন ব্যাংকিংসেবা বিকাশের মাধ্যমে চক্রের বিভিন্ন মহলে লেনদেন হয়। এই টাকার একটি অংশ বিভিন্ন হাত ঘুরে ভারতের শিলংয়ে জুয়া পরিচালনাকারীদের কাছে চলে যায়। অনলাইন জুয়াড়ি চক্রটি ইতোমধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App