×

সাময়িকী

খিদের অসুখে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:০১ পিএম

খিদের অসুখে

খিদের অসুখে

ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তায় আজ ভীষণ জ্যাম। এমনিতেই অফিসে কাজের ভীষণ চাপ। তার ওপর ফিরতে গিয়ে এমন জ্যামে অসহ্য লাগছিল রাজিবের। গাড়ি ফার্মগেটের মোড়টায় প্রায় ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে। এত সময় ধরে সে দেখছিল ওভারব্রিজের নিচে বসে থাকা দুইজন অল্পবয়সের তরুণীকে। আর খুবই অবাক লাগছিল রাজিবের যখন দেখতে পেলো তাদের দুজনের কোলেই রয়েছে দুটি ফুটফুটে বাচ্চা। ইস! এই বয়সে তারা মা হয়েছে! ভাবতেই বুকটা কেমন করে উঠলো। মেয়ে দুটোর গায়ে ছেঁড়া ময়লা কাপড়, ঠোঁটের দুকোণে সাদা সাদা ঘা। দেখে মনে হচ্ছে সন্তান ধারণের সময় থেকে অপুষ্টি তাদের গ্রাস করেছে। সুন্দর মুখ দুটো শুকিয়ে দুপাশের চোয়াল বের হয়ে আছে। আর মুখমণ্ডল লম্বাটে দেখাচ্ছে। এ ধরনের ছাপ শৈশবে রাজিব তাদের গ্রামেও অনেক মেয়ের মধ্যে দেখেছে। উঠতি বয়সের এসব মেয়েরা যে সময়ে বসন্তের কোলাহলে উচ্ছ¡ল আর খরস্রোতা নদীর মতো খেলে বেড়াবে মন, টসবগে যৌবনের কাছে মাথা নত করবে মহাকাল, তারা কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সত্যিই অবাক করে! একটু কথা বলতে শিখেছে এমন বাচ্চারা এটা ওটা খাবে বলে বায়না করছে। তখন তাদের মা তাদের গালে কষে থাপ্পড় মেরেছে। কত বাচ্চা আইসক্রিম খাওয়ার লোভে মালাইওয়ালার সাইকেলের পেছন পেছন ঘুরেছে! কেউ আইসক্রিম চুষলে এমনভাবে চেয়ে দেখেছে খাওয়া! আজ সেসব কথা; সেসব দৃশ্য খুব করে রাজিবের মনে পড়লো। নানা ধরনের চিন্তা তার মাথায় মাছের মতো খাবি খেতে লাগলো। তার আবার মনে পড়লো স্কুলের একটি ঘটনার কথা। প্রায়ই তার এ কথাটি মনে পড়ে। মনে হলে ভেতরটা কেমন যেন ফুঁড়ে বের হয়ে আসে। নিজেকে ভেঙেচুরে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে কোনো এক আঁস্তাকুড়ে। ছোটবেলার বন্ধু মানিক। একদিন মনসুর স্যার সবাইকে একে একে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন বড় হয়ে কে কি হতে চায়। প্রথম বেঞ্চ থেকে সবাই বলতে শুরু করেছে। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক। আবার কেউ কিছু না বলে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়িয়ে রইলো। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া যে আরো কিছু পেশার মধ্যে পড়ে কারো জানাই ছিল না। তাই বেশিরভাগ ছাত্রের উত্তর ছিল ডাক্তার। রাজিবও ডাক্তার হতে চেয়েছিল। কিন্তু আচমকা ক্লাস ভর্তি সবাই হেসে উঠলো যখন পঞ্চম বেঞ্চে বসা মানিক ইতস্তত করে বলে ফেললো- সে চাষা হতে চায়। খিলখিল করে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে সবাই, আবার স্যারের ধমকে চুপ। কী পাগল ছিল মানিক! হাসাহাসি শুনে ভীষণ লজ্জায় কাঁচুমাঁচু ভাব মানিকের, চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। সবার দিকে একনজর তাকিয়ে মাথাটা উঁচু করে স্যারের দিকে তাকালো। আর তখন মনসুর স্যার কঞ্চির লাঠি দিয়ে সাঁই সাঁই করে বেদম মারা মেরেছিল মানিককে। তার মারের শব্দে সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্যার চলে গেলে আবার সবাই মানিককে খ্যাপাতে শুরু করলো। মানিক যেন খুবই ভুল বলেছিল কৃষক হতে চেয়ে। ক্লাস শেষ করে বাড়ি এসে যতবার ঐ ঘটনার কথা মনে পড়েছে, ততবার হেসেছে রাজিব। কিন্তু আজকাল কথাটা মনে হতেই তার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে যায়। আজো তাই-ই গেল। বাসের ভেতর পাশের সিটে বয়স্ক লোকটি মুড অফ করে বসে ছিলেন। শীতকালে শীতের জড়তা যেমন প্রকৃতি ও প্রাণিকুলে প্রভাব ফেলে তেমনি রাজিবের মনের প্রভাবও যেন লোকটির মধ্যে পড়েছে। তিনি রাজিবের দিকে একটু তাকিয়ে আবার নড়েচড়ে বসলেন। প্রায়ই মানিকের কথাটি মনে হয় রাজিবের। মানিক কী সত্যিই কৃষক হয়েছে কিনা তা তার জানা হয়নি। কিন্তু সে তো ডাক্তার হতে চেয়েছিল বটে; হতে পারলো কই! আরো অনেকে তো বড় হয়ে ডাক্তারই হতে চায়, তাহলে দেশে এত ডাক্তার সংকট কেন? আর মনসুর স্যারই বা কেন মানিককে বেদম মার মেরেছিলেন? মানিক কী সত্যিই চাষা হবার স্বপ্ন দেখেছিল, না আমাদের মতো মনগড়া বলতে হয় তাই কিছু খুঁজে না পেয়ে বলে ফেলেছিল চাষা হবে। এসব নানা ধরনের কথা তার মনকে বিচলিত করে দেয়। আজ পর্যন্ত কোনো ছাত্র হয়তো কৃষক হবার স্বপ্ন বুকে লালন করেনি। বা ক্লাসে বলেছে কিনা জানা নেই। তাই বারবার মনে হয় সেই সত্যিকারের স্বপ্নটা দেখেছিল। যে দেশে শতকরা আশিভাগ লোক কৃষিতে নিয়োজিত সে দেশে তো কৃষক হবার লক্ষ্যটাই জরুরি; যেটা মানিক দেখেছে।

কখন যেন জ্যাম আর ক্লান্তি ওর মাথা থেকে নেমে গেছে একটুও টের পায়নি। বুকটা হাহাকার করে উঠে বারবার। পুঁজিপতি বিশ্বের যান্ত্রিক জীবনের প্রভাব তার উপরও পড়েছে। ইচ্ছা না থাকলেও বাধ্য হয়ে চাকরি করতে হচ্ছে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। তাই নিজের বহু যত্নে লালন করা বুকের গভীরের আবেগগুলো কখন যেন মাথা থেকে বিদায় নিয়ে এগুলো ভর করেছে তা নিজেও টের পায়নি। কর্পোরেট বিশ্বে মনের আবেগ অনুভ‚তির কোনো দামই নেই চাকরি করতে এসে ব্যাপারটি সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আজ অফিসে কলিগরা আলোচনা করছিল- এভাবে পরের অফিসে চাকরি না করে উদ্যোক্তা হয়ে নিজে কিছু করা ভালো। ক্ষেতে খামারে চাষ করেও অনেকে ভালো কিছু করেছে। একেবারে পরাধীন লাইফ আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহু আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছে রাজিব। মার্কসবাদ, কমিউনিজম, বস্তুবাদের নানা তত্ত¡ নিয়ে আলাপ-আলোচনা পাঠচক্র ইত্যকার কাজ সে গভীর এবং সুচিন্তিত মন নিয়ে করেছে। কোনোটাই আবেগে গা ভাসিয়ে নয়। আজ একটা বিষয় খুবই তার মনে হলো হঠাৎ করেই, আচ্ছা সমবণ্টন নীতিতে কী শুধু মানুষেরই দ্রব্যাদি ভোগ করার সমান অধিকার রয়েছে, না অন্যদের জন্যও? ধান নিয়ে যাওয়া কী ইঁদুরের অন্যায়ের মধ্যে পড়ে? এটা নিয়ে কমিউনিজমে কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা সেটা তার জানা হয়নি। তার বাবা তো মার্কসবাদ লেনিনবাদ পড়েনি; বুঝতোও না। ইবাদত বন্দেগি করে জীবন কাটিয়েছে। তবে সে কেন বলতো গোলার ধান ইঁদুর বা কাঠবিড়ালি খাচ্ছে খাক। ওদের হক আছে। আবার কোনো গাছের ফলমূল বিক্রি করতে দিত না। বলতো পাখি বা প্রতিবেশীর হক আছে। অথচ তাদের গ্রামের জোতদার মহাজন কাদির শিকদার। আড়ত ভর্তি ধানচাল মজুদ করে রেখে দাম বাড়িয়েছে। সুদে টাকা ছেড়ে অসহায় লোকজনকে ঠকিয়েছে। কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। উপরি তাকে সবাই সম্মানই করেছে। এমনকি তার বাবাও শিকদারকে তোয়াজ করে চলেছে। কেন করেছে? একবার ছোট বালক চান্দার মাথায় বাজারের ব্যাগ তুলে দিয়ে শিকদার বলেছিল তার বাড়ি রেখে আসতে। চান্দা রাজি হয়নি বলে পিটিয়ে কচি ডগার মতো বাহুগুলো সাপ মারার মতো মেরে থেঁতলে দিয়েছিল শিকদার। চান্দা তার পাশের বাড়ির জমিলা ফুফুর ছেলে। চান্দার বয়স তখন কত আর হবে! আট কী নয়। সে চিৎকার করে বাজার ভর্তি লোকের সামনে গালাগাল করছে... তোর বাজারের ব্যাগ আমি নিব কেন? আমি কি তোর চাকর?... চোখ থেকে পানি বুক বেয়ে দরদর করে পড়ছিল আর নাকের গড়িয়ে পড়া সর্দি হাত দিয়ে মুছে চান্দা বুক ফুলিয়ে জোরে জোরে দম নিচ্ছিল। ওর বুকের ছাতি ফুলে উঁচু নিচু করছিল। রাজিবের তখন মনে হয়েছিল চান্দা কত খারাপ! যাকে গ্রামের সবাই মান্যগণ্য করে তার কথা তো শুনলোই না আবার গালি দিল? কী সাহস চান্দার! সাপের মতো ফুঁসে ওঠে! বড় মানুষের মুখের উপর কথা! বড় হলে চোর ডাকাত হবে, কোনোদিন মানুষ হবে না। বাড়ি এসেও রাজিব নালিশ করে জমিলা ফুফুকে বলেছিল তার ছেলের কীর্তিকাহিনী। ঘটনা শুনে জমিলা চান্দাকে শিকদারের মারার ওপর আবার মেরেছিল। তারপর জমিলার কী যে কান্না! এই ঘটনার সাতদিন পর পাশের বিলে চান্দার লাশ পাওয়া যায়। সবাই বলে পানিতে ডুবে মারা গেছে। এখনো এই প্রশ্নটা রাজিবের মাথায় ঢোকে না। চান্দা খুবই ভালো সাঁতার জানতো। সে ডুবলো কি করে? মাকে বলতেই মা তাকে বুঝিয়েছিল জিনে মেরেছে। ওর মাকে মরার তিনদিন পর রাতে নাকি স্বপ্ন দেখিয়েছে চান্দা। আর সেও যেন পুকুরে বিলে না যায় এমন ভয় দেখিয়েছিল। এ কথা কখনো বিশ^াস হয়নি রাজিবের। এখন ঠিকই বুঝতে পারে সমাজে জিন কে বা কারা! আজো চান্দার সেই প্রতিবাদী চেহারা চোখ থেকে সরাতে পারে না রাজিব। জমিলা ফুফু চান্দাকে আদর করে বলতো আমার ছেলে বড় হয়ে খেজুর গাছ কাটবে, বাঁক ভর্তি রস পেড়ে বাড়ি আনবে, ক্ষেতে হাল বইবে, মাঠে শ্যালে মেশিন চালাবে। রাজিব শুনে কত না হাসতো। তখন ফুফু বলতো- হাসিস না আর, তোরা বড় হয়ে জজ বেরিস্টার হোসকে! আমার ছেলে দুমুঠো ভাতের পয়সা কামায় করলিই চলবেনে। কত খাওয়ার কষ্ট করচি! রাজিবের বুকটা আবারও ধক করে উঠলো। মনে পড়লো বাড়িতে ঈদে নতুন পোশাক বা শাড়ি-লুঙ্গি কেনা হলে চান্দা এসে দাঁড়াতো বারান্দা ঘেঁষে। শাড়ি বা লুঙ্গিতে লাগানো স্টিকারগুলোর প্রতি ছিল ওর মারাত্মক লোভ। বাড়ির সবাই স্টিকার তুলে নতুন পোশাক পরলে চান্দা স্টিকারগুলো নিয়ে গিয়ে ওদের বাড়ির দরজায় সুন্দর করে সাটিয়ে মেরে রাখতো। চান্দা মারা যাওয়ার পর প্রায়ই ফুফু ঘরের দরজায় লাগানো ঐ স্টিকারগুলোতে হাত বুলিয়ে দরজা ধরে ডুকরে কেঁদে উঠতো। দরজায় লাগানো সেই স্টিকারগুলো দেখতে খুবই মন পুড়ছে রাজিবের আজ। চান্দা বেঁচে থাকলে অন্তত তার মতো ভণ্ড হতো না। আবার রাজিব টানা দম নিয়ে উঠে। বুকটা পাথর হয়ে আছে। আচ্ছা তার মাথায় কেন হঠাৎ হঠাৎ এসব আসে? বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ঠিকই কিন্তু বাসটা আসলে এখন কোথায় বুঝতে পারে না। বাইরে সবকিছু ঝাপসা মনে হয়। কিছুক্ষণ পর বাস টেকনিক্যালে সিগনালে থামে। রাজিবের চেতনা হয়। হায়, হায়! সে তো শ্যামলী নামবে। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে একবুক শ্বাস নিয়ে পাশের দোকান থেকে সিগারেট জ¦ালায়। এই অন্যমনস্ক হওয়াটা কী তার কোনো রোগ কিনা বুঝতে পারে না। ছাত্রজীবনে পড়ার সময় সে অন্যমনস্ক হতো। চোখ বইয়ের দিকে কিন্তু মনটা কোথায় কোথায় চলে যেত। তার মাও কাঁথা সেলাই বা রান্নাঘরে রান্না করতে করতে এমন অন্যমনস্ক হয়ে কীসব ভাবতো। দুই-তিনবার ডাকার পরে উত্তর নিত। কেন মাকে এমন মাঝে মাঝে আনমনা দেখতো রাজিব? মাও কী তার মতো...? কিছু লোকের কী এমন হয় বাড়ির পথে রওনা দিতে দিতে কখন বাড়ি পেরিয়ে বহুদূর চলে যায় টের পায় না? চেনা পথ ভুল হয় না বলেই মানুষ ঠিকমতো অফিস বা বাড়িতে ফিরতে পারে। তা না হলে নাকি বেশিরভাগ মানুষই বাড়ি বা অফিস ভুল করতো। কথাটি সত্য কিনা জানা নেই। তবে রাজিবের জন্য তা আশ্চর্যরকমভাবে সত্য। আর গাড়িতে বা রিকশায় উঠে না। সিগারেট হাতে নিয়ে টান পায়ে হাঁটতে থাকে আবার পেছন দিকে। সিগারেটে টান দেয় আর ভাবে গতিশীল এই জীবনে পিছনের দিকে যদি এভাবে ফিরে যাওয়া যেত। তাহলে অতীতকে আরেকটু সুন্দর করে ঢেলে সাজিয়ে বা গুছিলে আনতে পারতো সবাই...

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App