×

জাতীয়

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২৭ এএম

৫৮ দিন পর সর্বোচ্চ মৃত্যু ৩৯
আক্রান্তের সংখ্যা ফের ২ হাজার ছাড়াল
নেগেটিভ সনদ থাকলেও বিদেশফেরতদের টেস্ট বাধ্যতামূলক

ঠিক এক বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে থাবা বসিয়েছিল করোনা। সেদিন আক্রান্তের সংখ্যা একজন থাকলেও এক বছর পর গোটা বিশ্বে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ কোটিতে। মারা গেছেন প্রায় দেড় কোটি মানুষ।

চীনে করোনা হানা দেয়ার প্রায় চার মাস পর গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এরপর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংক্রমণ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অক্টোবরে সংক্রমণের হার বেশ কিছুটা নিম্নমুখী হয়ে স্থিতিশীল থাকলেও নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত ৫৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর গত একদিনে শনাক্ত হয়েছে আরো ২ হাজার ২১২ জন করোনা রোগী, যা গত ৭১ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সবমিলিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ৬৮৪ জনে।

শীতের শুরুতেই হঠাৎ করে দেশে ফের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও গত কিছুদিন ধরে শীতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গত দু-তিন দিন ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকায় ধারণা করা হচ্ছে, দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ হয়তো শুরু হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে ব্যাপক হারে টেস্ট বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আর সেক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন ভিত্তিক র?্যাপিড টেস্ট কিটের ব্যবহার শুরু করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোসতাক হোসেন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু হঠাৎ করে বাড়লেও এখনই ঠিক নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে কি না। এটার জন্য আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। এটা ঠিক যে, গত দুদিন ধরে সংক্রমণ বাড়ছে, আজকাল আবার এটা কমে যেতে পারে। আবার হঠাৎ করে সংক্রমণের বিষ্ফোরণও ঘটে যেতে পারে। তবে এটা ঠিক, সংক্রমণ যত বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও তত বাড়বে। এজন্য যেকোনো মূল্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

এ বিষয়ে আরেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম ধাপে পর্যাপ্ত মাত্রায় পরীক্ষা করা হয়নি বলে অনেকে বাদ পড়ে গেছেন। যার কারণে সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এর ফলে বাদ পড়ে যাওয়ারাই এখন সংক্রমণের মাত্রা বেশি হারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সেটি এখন বন্ধ করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে অ্যান্টিজেনভিত্তিক র?্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করে নমুনা টেস্ট করাতে হবে। যাতে আধা ঘণ্টার মধ্যে টেস্টের রেজাল্ট দিয়ে রোগীকে বলা যায় যে তার কোভিড রয়েছে কি না এবং তাকে আইসোলেশনে যেতে হবে কি না। ঠিকঠাকভাবে কন্টাক্ট ট্রেসিং মহামারির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ন্ত্রণের আরেকটি শর্ত বলেও মনে করেন তিনি।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের তরফ থেকে সহসাই র‌্যাপিড টেস্টের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। মূলত কিট সংকটের কারণেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ধীরে চলো নীতিতে এগুচ্ছে। এ অবস্থায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র র‌্যাপিড টেস্টের অনুমতি পাওয়ার জন্য ফের আবেদন করেছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় তাদের আবেদনেরও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে করোনা মোকাবিলায় যারা নেগেটিভ সনদ নিয়ে দেশে ফিরবেন, বিমানবন্দরগুলোতে তাদেরও টেস্ট করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে একথা জানান তিনি। বিদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের সুপারিশ করা হবেও বলে জানান মন্ত্রী।

তিনি বলেন, নেগেটিভ সনদ নিয়ে আসলেও প্রত্যেককে আমরা টেস্ট করবো। যদি দেখা যায়, নেগেটিভ আছে তখন তাদের সেল্ফ কোয়ারেনটাইনে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ ব্যাপারে আমরা বেশ কড়া অবস্থানই নিচ্ছি। বিমান চলাচলের বন্ধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ফ্লাইট খোলা বা বন্ধ নির্ভর করবে পরিস্থিতির উপরে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এর মধ্যেই পররাষ্ট্র সচিবকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে করোনার সংক্রমণের শুরু থেকেই সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল। যা এখনো দৃশ্যমান। পাশাপাশি করোনার ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে, সেটা অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই করেছে বলে মনে করছেন তারা। এক্ষেত্রে আরও অপেক্ষা করা দরকার ছিল বলে তারা জানিয়েছেন। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন সংরক্ষণের বিষয়েও বাংলাদেশের আরো তৎপর উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি কেমন? এ প্রশ্নের জবাবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, গতকালও মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়ল। সামনে শীত, তাই করোনার সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে। তবে, মূল কথা হলো- মানুষ কোনোক্রমেই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। কেউই মানে না। মাস্ক পরে না, হাত ধোয়ার চর্চা কারো নেই, শারীরিক দূরত্ব মানছে না, মানুষের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক কেটে গেছে। রাস্তাঘাটে চললে তো মনেই হয় না যে দেশে করোনা আছে। কাঁধের ওপর কাঁধ দিয়ে সবাই চলাফেরা করছে। এমনকি হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগেও একই অবস্থা। কোনো দূরত্ব মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে ঢাকাতেই যেই অবস্থা, আর ঢাকার বাইরের তো কোনো খবরই নেই। মাস্ক পরে না, জানে না, বোঝে না। সেখানে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, করোনা বলে কিছু নেই। সর্বত্র গা-ছাড়া ভাব। শুধু আমাদের এখানেই নয়, এটা পৃথিবীব্যাপীই। আমাদের জীবনযাত্রা তো এখন স্বাভাবিক। বাস, ট্রেন, লঞ্চ সবই তো আগের মতো চলছে। এসব কারণেই সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়েছে।

মাস্ক পরা নিয়ে সরকারের পক্ষে আরও আগে থেকে তৎপরতা শুরু করা দরকার ছিল কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিসের’ ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে, শুধু তো আইন দিয়ে হবে না, মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রধান টেড্রস অ্যাডানম গ্যাব্রিয়েসাসও বলেছেন, প্রতিষেধক এলে মহামারি সামাল দেয়ার কাজে সুবিধা হবে। তবে শুধু প্রতিষেধক দিয়েই হবে, এমনটা কিন্তু নয়। প্রতিষেধকের একার পক্ষে মহামারি দূর করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, প্রতিষেধক এলেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। তাই নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে। যত বেশি সম্ভব টেস্ট করিয়ে, আক্রান্তদের আইসোলেশনে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে ঠিক কত জন এসেছেন, তাও যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বার করতে হবে। পর্যবেক্ষণে রেখে উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা দিতে হবে আক্রান্তকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App