×

মুক্তচিন্তা

শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২০, ১১:২১ পিএম

শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ
বিগত ১১ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুণ। অথচ শেয়ারবাজার যেন একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৮ সালে চীনের বিশ্বখ্যাত দুই স্টক এক্সচেঞ্জ-সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জ কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে ডিএসইর সঙ্গে যুক্ত হয়েও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে গতিশীল করতে পারেনি। সম্পদ বা পণ্য বৈচিত্র্যের দিক থেকে আমাদের শেয়ারবাজার অসম্পূর্ণ। বর্তমানে এটি শুধুই ইক্যুইটিনির্ভর বাজার। শেয়ারবাজার গতিশীল করতে নতুন পণ্য চালু যেমন সরকারি এবং করপোরেট বন্ড, সূচকনির্ভর পণ্য, এবিএস, অপশনস ও ডেরিভেটিভস চালু করতে হবে। আশার কথা হলো, নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে নতুন নতুন প্রোডাক্ট আনার জন্য কাজ করছেন। যা দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজারে গতি সঞ্চার করবে। মানসম্মত কোম্পানি, সুশাসন, যথাযথ জ্ঞান ও গবেষণাই পারে শেয়ারবাজারকে কাক্সিক্ষত উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে। বিনিয়োগের সঙ্গে বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের শেয়ারবাজারের কাক্সিক্ষত বিকাশ ঘটবে না। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজারে যা ঘটেছে তা দেশের নাগরিক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই হতাশার। তাই শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিতে হলে বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা সবার আগে দরকার। আর বিনিয়োগকারীদের জ্ঞানই হচ্ছে তার প্রথম সুরক্ষা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এটি তথ্য সংবেদনশীল একটি পেশাদার কাজ। এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগকারীদের পেশাদারি দক্ষতা এবং জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে আমাদের বাজারে সাধারণ ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারী মোট বিনিয়োগকারীর প্রায় ৭৫ শতাংশ। অধিকাংশ শেয়ার কেনাবেচার বিভিন্ন দুর্বল পথ-প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ে। লাভের বিপরীতে তারা লোকসানের মুখে পড়েন। নিজেদের অজ্ঞতা, অসতর্কতা, অসচেতনতা ও ত্রæটিপূর্ণ বিনিয়োগের ফলে বাজারের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বাজারবিমুখ হয়ে পড়েন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন, পাশাপাশি বাজারের মৌলিক কাঠামোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নয়। বরং দুই থেকে তিন দশকের অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও হুজুগে শেয়ার কেনাবেচা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এতে যে শুধু ব্যক্তি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে তা নয়। বরং একই সঙ্গে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করতে পুঁজির প্রধান উৎস হয়ে ওঠার পথে বারবার হোঁচট খাচ্ছে শেয়ারবাজার। অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে তার সঙ্গে শেয়ারবাজারের অবস্থা একেবারেই বেমানান। এ অসামঞ্জস্যতা বিদেশিদের কাছে জাতি হিসেবে আমাদের আর্থিক জ্ঞানের অজ্ঞতা প্রকাশ করে ও লজ্জিত করে। আমাদের শেয়ারবাজার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী অথবা এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাজার সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা ও যথাযথ জ্ঞানের অভাব। অবাক করা বিষয় বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগে দক্ষতা নেই এমন কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগের দায়িত্ব দিচ্ছে। গবেষণাভিত্তিক বিনিয়োগ দক্ষতা না থাকায় কোম্পানির গোপন খবর সংগ্রহ করে বা জুয়াড়িদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন গ্রæপে ভাগ হয়ে কারসাজি করে। গুজব ছড়িয়ে শেয়ারদর বাড়ানো হচ্ছে। সবাই গুজবের পেছনে ছুটছে। বাজারকে সুষ্ঠু ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে আগে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ ও যোগ্য বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক বা জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত দেশে তো বটেই, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও শেয়ারবাজারের দৈনিক বিনিয়োগের ৭০-৯০ ভাগ পর্যন্ত হয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে। বাকিটা ব্যক্তিশ্রেণির ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর। বাংলাদেশে পরিসংখ্যানটি ঠিক উল্টো। এখানকার শেয়ারবাজার পুরোপুরি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীনির্ভর। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কম এবং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির বাইরে বড় বিনিয়োগ সক্ষমতা আছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। অথচ প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ তহবিলের বড় অংশ আসে ব্যক্তি বিনিয়োগ থেকে। অর্থাৎ ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা নিজেরা সরাসরি বিনিয়োগ না করে পেশাদার বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ তুলে দেয়। তারা গবেষণানির্ভর বিনিয়োগ করে ব্যক্তিকে মুনাফা দেয়। এ বিনিয়োগের বড় অর্থ আসে মিউচুয়াল ফান্ড ও ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এ চর্চা নেই বললেই চলে। বাজারসংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন থেকে এ চর্চা বাড়ানোর কথা বলছেন। পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করে দক্ষ ও যোগ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করতে হবে। তাহলে বিনিয়োগে গুণগত মান বাড়বে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যখন দেখবেন, নিজে বিনিয়োগ করা থেকে ভালো মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ, তখন তারা সেদিকে ঝুঁকবেন। এভাবে বাজারে ভারসাম্য ফিরবে। সেই কাজটি অবশ্য খুব বেশি হচ্ছে না। সম্প্রতি দেশের শেয়ারবাজারে সাধারণ বিমা খাতের কোম্পানিগুলো সর্বনিম্ন সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ পৌনে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। নির্দিষ্ট এই খাতের টানা উত্থান বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। ভালো ভালো শেয়ার যেখানে অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে আছে, সেখানে বিমা কোম্পানির শেয়ারের দাম যেন আকাশমুখী। মৌলিক কোনো কারণ ছাড়া কেন বিমা খাতের এ মূল্যবৃদ্ধি? আমাদের বাজারে সবচেয়ে বেশি কাজ করে ‘হার্ডিং ইফেক্ট’ প্রবণতা অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা সব একযোগে একই দিকে ছোটে। একদল বিনিয়োগকারী দাম বাড়বে এ গুজব ছড়িয়ে দেয় আর অন্যরা সবাই তার পেছনে দৌড়াতে থাকে। কেন দাম বাড়ছে, বেশিরভাগ সময় তা খতিয়ে দেখেন না। আমাদের শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আচরণগত দিক দিয়ে উভয়ই একই রকম। যা মোটেও একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল বাজার গঠনে কাম্য নয়। সুষ্ঠু বাজার তো নির্ভর করে সব ধরনের বিনিয়োগকারীর সুষ্ঠু আচরণের ওপর। হার্ডিং ইফেক্ট বলি আর বাজারে সূচকের অস্থিরতা বলি সেটা তো সব বিনিয়োগকারীর আবেগের বা আচরণের সমষ্টি। আর এই বিনিয়োগ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর একমাত্র উপায় হলো বিনিয়োগ শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। দেশে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের সচেতন ও বিনিয়োগে প্রশিক্ষিত করার বিকল্প নেই। তবে বড় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আচরণ সংশোধন না করে ক্ষুদ্রদের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর পদক্ষেপ কতটুকু কাজে আসবে তা অধিকতর বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ আমাদের শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সবসময় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বা ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীদের অনুসরণ করে থাকে। স্বাভাবিকভাবে বড় বিনিয়োগকারীদের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা বেশি। সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল বাজার গঠনে নৈতিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মৌলিক বিষয়াদিতে মনোযোগ দিতে হবে। তাই স্থিতিশীল শেয়ারবাজার নিশ্চিত করতে হলে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক শিক্ষা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভোক্তারা এই শিক্ষার মাধ্যমে উপকৃত হলে দীর্ঘমেয়াদে বাজার হবে স্থিতিশীল, যা সার্বিক অর্থনীতির জন্যও সুফল বয়ে আনবে। মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App