ম্রো আদিবাসীদের উৎখাত ও ম্যারিয়ট হোটেল
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২০, ১১:১৫ পিএম
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে গেলে ম্রো আদিবাসীদের দেখা মিলে। বর্তমানে মতান্তরে প্রায় ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার ম্রো পরিবারের বাস পার্বত্য চট্টগ্রামে। প্রাচীন বিশ্বাসমতে, মুরংরা হচ্ছে আরাকানের প্রাচীন এবং বিখ্যাত আদিবাসী। এমনকি দশম শতাব্দীতে দুজন মুরং রাজা আরাকান শাসন করেছেন। ৯৫৭ সালে আম্যাথু এবং ৯৬৪ সালে পাই-ফিউ রাজা ছিলেন। আর সে সময়টাতে আরাকানের রাজধানী ছিল ওয়েথেইলি। ইতিহাসবিদদের ধারণা, বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে ম্রো জাতিগোষ্ঠীই সবচেয়ে প্রাচীন। শুধু বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার সর্বত্রই নয়, বরং পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ম্রো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সাধারণত ম্রোদের মুরং নামেও ডাকা হয়। মুরং শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ম্রো থেকে, যার অর্থ মানুষ এবং মুরং অর্থ মানব সমাজ। ধারণা করা হয়, ম্রোরা হচ্ছে বার্মার চীন জাতির গোত্রভুক্ত। ম্রোরা ওয়াকিম, খামি (খিমি), কিউই, মায়ি নামেও পরিচিত।
সম্প্রতি ম্যারিয়ট একটি আমেরিকান কোম্পানি কর্তৃক বান্দরবান শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক-থানচি রোডে ‘ম্যারিয়ট হোটেল এন্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ নামে ফাইভ স্টার হোটেল তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে। যেখানে রয়েছে ম্রো আদিবাসীদের বসবাস। জানা গেছে, হোটেলের বাস্তবায়নে কাজ করবে শিকদার গ্রæপের প্রতিষ্ঠান আর আর হোল্ডিংস ((R R HOLDINGS)) এবং বাংলাদেশ আর্মির ৬৯নং ব্রিগেডের ২৪নং ডিভিশন। ম্রোদের মতে, এই হোটেল তৈরিতে তিনটি ম্রো পাড়া পুরোপুরি উৎখাত করতে হবে এবং হুমকির মুখে পড়বে আশপাশের আরো ৫টি ম্রো পাড়া। আর তাই এই কন্সট্রাকশন বন্ধ করতে সুপারিশ করেছে The International Chittagong Hill Tracts Commission (CHTC)। এর আগে কাপরুপাড়া, দোলাপাড়া, এরাপাড়া এবং চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসকারী ম্রোদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে এই হোটেল তৈরি বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস বরাবর পিটিশন জমা দিয়েছেন। ম্রোদের অভিযোগ, ট্যুরিজমের নামে আদিবাসী উৎখাত অনেকদিন ধরেই বান্দরবানে চলে আসছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা আদিবাসীদের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। আদিবাসী দিবস পালন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বেলায়ও আদিবাসী কোটায় ভর্তির সুযোগ-সুবিধা তাদের দিয়েছেন। তিনি নিশ্চয় আদিবাসীদের বিপদের মুখে ফেলবেন না। আদিবাসীদের বসবাসের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশে স্থানান্তরিত করেই হোটেল তৈরির বন্দোবস্ত করবেন। তবে প্রত্যেকেরই বসতভিটার প্রতি অন্যরকম একটা টান, মায়া থাকে। কেউই চাই না তার বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে। ম্রোদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নই। তারাও ছাড়তে চায় না তাদের পাহাড়ি এলাকা। যেখানে তাদের আত্মা মিশে আছে। আর তাই ম্রো আদিবাসীরা আন্দোলনে নেমেছে এই ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ বন্ধ করতে।
কিন্তু পর্যটনের মাধ্যমে দেশের মানুষের উন্নয়ন হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ম্রো আদিবাসীও হতে পারবে তার একাংশ। তাছাড়া ম্যারিয়ট হোটেল এন্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক তৈরি করতে সম্পূর্ণ পাহাড়ি এলাকা তো ব্যবহৃত হবে না। কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে হোটেলের বর্জ্য, প্লাস্টিক জনজীবনকে ক্ষতির সম্মুখীন করা হবে। তাই বর্জ্যরে সঠিক নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেই হোটেল নির্মাণের চিন্তা করতে হবে।
জানা যায়, ম্যারিয়ট একটি আমেরিকান কোম্পানি। যার মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো না হয়। ভারতীয় কোম্পানি যেমন মাঝপথে কাজ অসম্পন্ন রেখে দেউলিয়া হয়েছে এমনটা যেন না হয় তা আগে থেকেই বিবেচনা করতে হবে। মূলত পাহাড়ি, আদিবাসীদের সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করেই এই হোটেল তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তাই লক্ষ রাখা জরুরি ফাইভ স্টার হোটেল তৈরি করতে গিয়ে যেন মূল সৌন্দর্যের কোনো ক্ষতি না হয়। দেশের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারলে অনেক কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে হলে পর্যটন স্পটগুলোতে ভালো হোটেল আর নিরাপত্তা জরুরি। সর্বোপরি হোটেল তৈরি করা এখানে অন্যায় নয়। কিন্তু এর জন্য যদি কাউকে ঘর-বাড়ি ছাড়তে হয় তাহলে তাদের সঠিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া জরুরি এবং তারপরই হোটেল, পার্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[email protected]