×

মুক্তচিন্তা

অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা কেন?56

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২০, ১০:৩৫ পিএম

বিশ্বব্যাপী করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে, আমাদের দেশেও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার থেকে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হচ্ছে। যদিও মানুষের মধ্যে করোনাভীতি আগের মতো লক্ষ করা যাচ্ছে না, তবে শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে করোনার পাশাপাশি হাঁপানি, নিপা ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার সম্ভাবনা চিকিৎসক মহল উড়িয়ে দিচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে কোভিড, নন কোভিড হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে গোটা দেশ আবার কিছুটা হলেও মহামারির সংকটের কথা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। তবে জীবন-জীবিকা তথা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে যুক্ত থাকতেই হচ্ছে। কেননা গত মার্চ মাস থেকে করোনা সংকটে বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশও লকডাউন পালন করতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ক্ষতি এখনো অনেকেই পুষিয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী, কর্মজীবী বিভিন্ন পেশার মানুষ নিজেদের আয়-উপার্জন অনেকটাই হারিয়েছে। যদিও এরই মধ্যে সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে, তবুও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বিগত সংকটকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ এখনো পায়নি। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার ওপর করোনাকালীন সংকট এখনো এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আমাদের জন্য বিশেষ স্বস্তি এবং সাফল্যের বিষয় এই যে করোনাকালীন এই সময়ের অর্থনৈতিক চাপ, পাঁচবারের দীর্ঘমেয়াদি বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের দুর্যোগ ঘটা সত্ত্বেও সরকারের অব্যাহত সহায়তায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, মহামারির সংকটকালে বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রদান এবং কার্যকর নীতি সহায়তার দ্বারা রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম পাঁচটি ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তালিকায় অবস্থান করে নিতে পেরেছে। অথচ করোনা শুরুর কালে অনেক দেশই আঠারো কোটি জনসংখ্যার এই দেশে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের সমূহ সম্ভাবনার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে করোনার চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি পাঁচটি দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় বেশ ঝাঁকুনি খেয়েছে। সে কারণে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বেশকিছু দ্রব্যমূল্য আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়। এটিও আরেকটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তারপরও স্বীকার করতে হবে করোনা মহামারির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলই প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ ধরনের একটি জটিল পরিস্থিতিতে জাতীয় জীবনে যেখানে সংকট অতিক্রম করার সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টায় সব মহলের অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত ছিল, সেটি খুব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত না হওয়াটি খুবই দুঃখজনক। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের পাশে যেভাবে সাহায্যের হাত নিয়ে দাঁড়ানোর আশা করা হয়েছিল সেটি খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। অধিকন্তু বিভিন্ন মহল দেশে নানা ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করে চলছে। প্রবাসে বসে কোনো কোনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠী অনলাইন তথা সামাজিক গণমাধ্যমে একের পর এক প্রচার-প্রচারণায় সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীসমূহের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার, মিথ্যাচার, সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি ছড়ানোর নানা ধরনের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বজায় রেখে দুর্নীতিবাজ, নারী নির্যাতনকারী, ধর্ষক, বিপথগামী কিছু পুলিশ কর্মকর্তা, দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী-ঠিকাদারসহ অনেককেই গ্রেপ্তার ও আইনের কাছে সোপর্দ করায় ওই মহল বিষয়গুলোকে রংচং দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর মহোৎসবে মেতে ওঠে। সরকারের এসব উদ্যোগ এবং দৃঢ় অবস্থান দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা হিসেবে মানুষের কাছে গৃহীত হয়। প্রকৃতপক্ষে সুশাসনের পথে একধাপ অগ্রগতি হিসেবেই এটি জনগণের কাছে বিবেচিত হয়। কেননা দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানে সরকারি দলের পরিচয় থাকা সত্ত্বেও কেউই রেহাই পায়নি। বিষয়টি গণমাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ মানুষ দেখতে পেয়েছে। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বা অনাস্থা তৈরি হওয়ার তেমন কোনো কারণ ঘটেনি। যদিও দেখা গেছে যে একটি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরপরই সামাজিক গণমাধ্যমে নানা ধরনের অপপ্রচার-উত্তেজনা ছড়ানো হয়েছিল, কিন্তু সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপরাধীদের আইনের কাছে সোপর্দ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সে কারণে সরকারবিরোধী কোনো জনমত তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। যদিও প্রধান বিরোধী দল ঘটনার পরপর সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু বাস্তবে সরকার আইনের পথেই হেঁটেছে। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে মাঠ গরম করার মতো কোনো রাজনৈতিক ইস্যু বিরোধী দলের হাতে ছিল না। তাই মাঠে সরকারবিরোধী রাজনীতি তেমন উত্তাপ ছড়তে পারেনি। এরপরও সামাজিক গণমাধ্যমে কোনো কোনো মহল ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং দহগ্রামে একজনকে পিটিয়ে হত্যা ও পুড়িয়ে মারার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটিয়ে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হয়েছে। আরো বেশ কিছু বিষয় নিয়েও দেশে নানা ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু দেশের বৃহত্তর জণগোষ্ঠী এসব অপপ্রচারে সাড়া দেয়ার কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি। গত ১২ নভেম্বর ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে দুটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উভয় আসনে অওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। করোনা এবং অন্যান্য কারণে এসব নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের আগ্রহ খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়নি, কিন্তু ভোটের দিন ঢাকায় আকস্মিকভাবে ১১টি বাসে অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়েছে। এই অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটানো হয়েছে। এ বিষয়ে একটি ফোনালাপ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল, তাতে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা-নেত্রীর আলাপ থেকে জানা যায় যে যুবদলের কর্মীরাই এই অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত ছিল। বিএনপি অবশ্য তাদের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার কথা বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছে। দলের মহাসচিব এটিকে সরকারের বিভিন্ন এজেন্ট ও বাহিনীকে দিয়ে ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। তবে ফোনালাপের ভিডিও দেখা ও শোনার পর মহাসচিবের এই বক্তব্য খুব কম মানুষের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। যুবদলের কর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়টি এই কারণেই সবার কাছে বোধগম্য হয়েছিল যে ঢাকা-১৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন যুবদলেরই একজন নেতা। নির্বাচনের আগেই তারা নির্বাচন নিয়ে নানা রকমের হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। খুব সঙ্গত কারণেই ১১টি বাসে আগুন লাগানো এবং ফোনালাপের ভিডিও শোনা ও দেখার পর এটি তাদেরই কর্মকা- বলে অনুমিত হয়। তাছাড়া সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা গেছে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে পুলিশ বাহিনী দাবি করছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে, শিগগিরই হয়তো বাসে অগ্নিসংযোগের এ ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। তবে বাসে অগ্নিসংযোগের এ ঘটনা রাজনীতিতে কিছুটা হলেও উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। কিন্তু এই উত্তেজনা কারো জন্যই খুব একটা লাভ বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। এই জ্বালাও-পোড়াও কা-ে যুবদলের যুক্ত থাকার বিষয়টি যদি প্রমাণিত হয় তাহলে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা ২০১৪-১৫-এর মতোই বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি মহল সামাজিক গণমাধ্যমে নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে, আবার অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের মধ্যেও নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছে যা জাতীয় রাজনীতিতে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত বহন করে বলে রাজনীতি সচেতন মহল মনে করছেন। মূলত এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনাড়ম্বরভাবে পালিত হচ্ছে কিছু কিছু কর্মসূচি দ্বারা। বছরটিকে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সামনে ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস, এই মাসে নানা ধরনের কর্মসূচি থাকতে পারে। তার আগেই মুজিববিরোধী শক্তি দেশে নানা ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে সরকারকে ব্যস্ত রাখার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে এসব ঘটনা ও প্রচারণায় মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা থাকতে পারে। সে কারণে নভেম্বরের বাকি দিনগুলোতে আরো কিছু ঘটবে না এমনটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না। একটি অস্থিরতা তৈরির জন্য কারো কারো কাছে করোনার এই সময়টি উপযুক্ত। তবে জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত মানুষ এমন অস্থির রাজনৈতিক চিত্রের সঙ্গে কতটা যুক্ত হবেÑ সেটি সন্দেহের বিষয়। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App