×

জাতীয়

হেফাজতে ভাঙনের আলামত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২২ এএম

সম্মেলন ঘিরে কওমি অঙ্গনে অস্থিরতা * শফীকে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য প্রতিনিধি সম্মেলন আহ্বানকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা চলছে দেশের কওমি অঙ্গনে। এ নিয়ে সংগঠনটিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র হয়ে উঠেছে। আলেমদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে অস্বস্তি। এ পটভ‚মিতে সংগঠনটির বিভক্তির আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০১৩ সালে ব্লগারদের বিরুদ্ধে ১৩ দফা দাবি নিয়ে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম। এরপর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের সখ্যতা গড়ে ওঠে। গত কয়েক বছর ধরে সরকারের সঙ্গে সখ্যতার প্রশ্নে সংগঠনটিতে পক্ষে-বিপক্ষে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়। কারণ সরকারবিরোধী বিভিন্ন ইসলামপন্থি দলের নেতারাও সংগঠনটিতে রয়েছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর বর্তমানে সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্তি দৃশ্যমান হয়েছে। দুই পক্ষের নেতাদের বক্তব্যেও তা উঠে এসেছে।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় আজ রবিবার হেফাজতের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই নির্ধারণ হবে সংগঠনটির নতুন নেতৃত্ব। এ অবস্থায় সংগঠনটির প্রয়াত আমির আহমদ শফীর অনুসারীরা এই সম্মেলনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে হেফাজতে ইসলামকে ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রামে সম্মেলনের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ মিছিল ও লিফলেট প্রচারণাও চালিয়েছে আলেমদের একটি বিক্ষুব্ধ পক্ষ। এছাড়া আল্লামা শফীকে জামায়াত-শিবির পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ও চট্টগ্রামের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজকের সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাননি হেফাজতের তিনটি অংশের (শফী অনুসারী) নেতারা। এই তিনটি অংশ হলোÑ জমিয়ত (মুফতি ওয়াক্কাছ অংশ), ইসলামী ঐক্যজোট ও আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী গ্রুপ। এছাড়া আমন্ত্রণ না পাওয়াদের মধ্যে মধুপুরের পীরও রয়েছেন। এ বিষয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (মুফতি ওয়াক্কাস-নায়েবে আমির হেফাজত) সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি রেজাউল করিম জানান, তারা কোনো আমন্ত্রণ পাননি। ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, মুফতি মঈনুদ্দিন রুহিও আমন্ত্রণ পাননি। তারা দুজনেই হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্বে রয়েছেন। আহমদ শফীর পক্ষাবলম্বনকারী নেতারা জানিয়েছেন, আজ হেফাজতের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত

দেখেই তারা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন। এ বিষয়ে আহমদ শফীর ছেলে সংগঠনটির প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানী বলেন, আমাদের কাউকেই সম্মেলনে ডাকা হয়নি। সম্মেলনের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, হেফাজতকে ভাঙনের উদ্দেশ্যেই তাদের আমন্ত্রণ না দেয়া হতে পারে। সংগঠন অক্ষুণœ রাখার উদ্দেশ্য থাকলে তাদের উদারতা দেখানোর দরকার ছিল। এ বিষয়ে মুফতী মঈনুদ্দিন রুহি বলেন, যেদিন হেফাজত গঠন হয়েছে, সেদিন থেকেই আমি এর যুগ্ম মহাসচিব। হেফাজতের কাউন্সিল করার জন্য এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনো আলোচনা বা মিটিং কখনো করা হয়নি। একজন ব্যক্তির আমির হওয়ার জন্য এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ হাসিল করার জন্য এই কাউন্সিল করা হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। এতে আল্লামা শফীর অনুসারী এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনীর অনুসারীদের দাওয়াত দেয়া হয়নি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, হেফাজতকে খণ্ডিত, বিভক্ত বা ভাগ করার জন্য এটা একটা দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা। এ অবস্থায় আহমদ শফীর অনুসারীরা ওই প্রতিনিধি সম্মেলনের বিরুদ্ধে তাদের করণীয় ঠিক করার জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছেন।

এদিকে সম্মেলনের আয়োজকরা জানিয়েছেন, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী সম্মেলন পরিচালনা করবেন। আর বাবুনগরীর আত্মীয় মহিবুল্লাহ বাবুনগরী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন এবং তিনিই এই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক। তাকে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আহমদ শফীর অনুসারীরা। তারা বলেছেন, মহিবুল্লাহ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলাম থেকে অনেক আগে পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি কোনো সম্মেলন আহŸান করতে পারেন না। তবে শফীর অনুসারীদের বিরোধী অংশের নেতা এবং হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, তারা বৈধভাবেই সম্মেলন ডেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। এখানে কিছু লোকের বিরোধিতার কারণে তাদের সংগঠনে ভাঙনের কোনো বিষয় নেই। তিনি বলেন, যারা সম্মেলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তারা আসলে হেফাজতের এই উত্থান সম্পর্কে জনগণকে বা আমাদের কর্মীদের বিভ্রান্ত করে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ করার জন্য চেষ্টা করছেন। ইসলামাবাদী বলেন, এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিভক্তি নয়, ঐক্যবদ্ধ হবে হেফাজত। যাদের ব্যাপারে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ, তাদের তো হেফাজতের কমিটিতে রাখার সুযোগ নেই।

এদিকে আজ (রবিবার) অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি সম্মেলনে সংগঠনটির মূলধারাকে বাদ দিয়ে চোরাইপথে কমিটি গঠন করা হলে তা বাংলাদেশের আলেম সমাজ মেনে নেবে না বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। গতকাল শনিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। ফয়জুল্লাহ বলেন, হেফাজতের ঐতিহ্য ভ‚লুণ্ঠিত করে যারা হেফাজতকে একটি চিহ্নিত মহলের ক্রীড়নকে পরিণত করতে চাচ্ছে, অচিরেই জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। একই সঙ্গে হেফাজতের মূলধারাকে বাদ দিয়ে যারা হেফাজতের একজন পদত্যাগী নেতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে এই সংগঠনকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র করছে, এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ বিশেষত উলামায়ে কেরামরা তা কোনোদিনই মেনে নেবে না।

এছাড়া গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবেও শফী অনুসারীরা ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির কাউন্সিল বন্ধের দাবি জানান। অনুষ্ঠানে হেফাজতের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার প্রচার সম্পাদক আ ন ম আহমদ উল্লাহ বলেন, সবাইকে নিয়ে সম্মেলন করে হেফাজতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য সম্মানিত অনেক আলেম চেষ্টা করছেন। তাতে সরকারের দালাল বলে এসব আলেমরা নাজেহালও হয়েছেন। তবু আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব। যদি না হয়, তাহলে নতুন হেফাজতের কার্যক্রম ঘোষণা করব। তিনি বলেন, এই সম্মেলনের ডাক অবৈধ। কারণ যিনি এই সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন দুই বছর আগে তিনি পদত্যাগ করেছেন। এরপর আর তিনি হেফাজতে ফেরার ঘোষণাও দেননি। তিনি কীভাবে সম্মেলন ডাকেন? তাছাড়া এই সম্মেলনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির কেউ কিছু জানে না।

জবাবে বাবুনগরীর সমর্থকরা বলছেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই দলের মহাসচিব এই সম্মেলন ডেকেছেন। সম্মেলনে জুনায়েদ বাবুনগরী নতুন আমির ও নূর হোসাইন কাসেমী মহাসচিব হচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া অন্য কয়েকটি শীর্ষ পদেও পরিবর্তন আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এতে মামুনুল হক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও হারুন ইজহার সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পেতে পারেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App