×

মুক্তচিন্তা

‘সুতরাং’ এবং সুভাষ দত্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০৮:২০ পিএম

‘সুতরাং’ এবং সুভাষ দত্ত
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প যখন পশ্চিম বাংলার সেরা সব বাংলা ছবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবির প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় নিরুদ্দেশ যাত্রী, এই ঢাকাতেও উর্দু ছবি নির্মাণের বন্যা বইতে শুরু করেছিল, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে রক্ত দিতে হচ্ছিল, স্বাধিকার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অয়োময় আকাক্সক্ষা যখন দানা বাঁধছিল সেই সময়ে ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ ছবি নির্মাণ করে বাঙালির, বাংলা সংস্কৃতির, সৃজনশীলতার, মৌলিকত্বের মর্মমূলে যেন আত্মবিশ্বাসের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। সুতরাং সবাই নতুন চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, নায়িকা, নায়ক, প্রযোজক এরা সবাই যেন এক কাতারে শামিল হলেন নতুন পথের, প্রত্যয়দীপ্ত নবযাত্রার অভিষেক ঘটাতে। সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প নেন ১৯৬২ সালের শেষের দিকে। পত্রিকায় সুতরাং বানানোর বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাবাজারের মেসে বসবাসকারী জনৈক সত্য সাহা সত্যই সাহস করে এসে সুরকার হতে চাইলেন আমি সত্য সাহার দু-একটা পরীক্ষা নিলাম। কেমন সুরটুর জানে। তারপর ছবির সিচুয়েশন নিয়ে বসলাম। বললাম এ ধরনের গান লাগবে আমার ছবিতে। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। এটা হওয়ার পরে আমি নায়িকা খুঁজব। যেহেতু আমি বেঁটে মানুষ। তাই ছোটখাটো একটা মেয়ে দরকার আমার বিপরীতে, নায়িকা হওয়ার জন্য। তার নায়িকা চট্টগ্রামের মিনা পাল। তার আবিষ্কারের কাহিনীটিও অভিনব ‘আমি ছবির ষোলোটি দৃশ্যের স্কেচ এঁকে পাঠালাম। স্কেচ দেখে মিনার ছবি তুলে আনলেন সত্য সাহা। কয়েকটি ফটোগ্রাফ খুবই ভালো লাগল। বললাম, ঠিক আছে। ওকে আসতে বলো। তারপর মিনা তার বাপ এবং বোনদের নিয়ে ঢাকা এলো। এখন আমার দুই প্রডিউসার ওকে দেখে হৈচৈ করে উঠলেন। আরে, এ দেখছি খুবই ছোট মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে। একে দিয়ে হবে নাকি। মিনা পাল ফ্রক পরা ছিল। আমি বললাম, ফ্রকটা ছেড়ে শাড়ি পরে এসো। ওরা নবাবপুরে, ঢাকা বোডিংয়ে উঠেছিল। সে হোটেলে গিয়ে শাড়ি পরে এলো। দেখলাম ভালোই লাগছে। মুহূর্তে শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতির মতো মিনা পাল থেকে কবরী বেরিয়ে আসে। ওর চেহারার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওর হাসি।’ ২৩ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে ছবিটি মুক্তি লাভ করেছিল। ছবিটির চিত্রনাট্য ও পরিচালক সুভাষ দত্ত, চিত্রগ্রহণ কিউ এম জামান, সম্পাদনা ইনামূল হক, গীতিকার সৈয়দ শামসুল হক, সংগীত পরিচালক সত্য সাহা, প্রযোজক চিত্র চৌধুরী ও এম এ খায়ের। অভিনয় সুভাষ দত্ত, কবরী, বেবী জামান, শওকত আকবর, রানী সরকার, মঞ্জুশ্রী, রহিমা খালা, খান জয়নুল প্রমুখ। ‘রাশোমোন’ (১৯৫০) যেমন জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরো সাওয়ার (১৯১০-১৯৯৮), ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) যেমন সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১-১৯৯২) অমরত্বের স্বপ্ন জাগানিয়া ছবি ‘সুতরাং’ (১৯৬৪) তেমনি সুভাষ দত্তের “ফ্রাঙ্কফুর্ট এশীয় চলচ্চিত্র উৎসবে সুতরাং দ্বিতীয় পুরস্কারে বিজয়ী হয়েছিল। পুরস্কার-টুরস্কার নয়, ‘সুতরাং’ আমার বড় আদরের সন্তান। বিপুল এক শিল্প নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল ছবিটি নির্মাণের সময়। আমি নিঃসঙ্কোচে শ্রম ও সাধ্য ঢেলেছি এতে। আমি মরণশীল সামান্য মানুষ। শিল্প মানুষকে অমরত্ব দেয়। আমি উচ্চাভিলাষী নই, তবে এটুকু বলতে পারি, আন্তরিক সৃষ্টি হিসেবে ‘সুতরাং’ বেঁচে থাকবে।” তৎকালীন বাঙালি সমাজের প্রতিচ্ছবি এতে দৃশ্যমান হয়েছে। এ দেশের চলচ্চিত্রের মাইলফলক এই চলচ্চিত্রটি শুধু সুভাষ দত্ত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেনি, বহির্বিশ্বে এ দেশকে পরিচিত করেছে। এই ছবিটি প্রথম বাংলা ছবি হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের অনেকগুলো কাজের সূত্রপাত ঘটেছিল ‘সুতরাং’-এর মাধ্যমে। এ দেশের চলচ্চিত্রে প্রথম রিমিক্স প্রথা চালু হয় ‘সুতরাং’-এ। ভাই-বোনকে দিয়ে প্রথম ডুয়েট গানের প্রচলন, সর্বপ্রথম স্বপ্নদৃশ্যের অবতারণা এবং এ দেশে প্রথম বিয়োগান্তক ছবিও এটি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা নির্মিত চলচ্চিত্রের সর্বাধিক আয় করেছিল ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্র। এ ছবির নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ টাকা, আয় হয়েছিল প্রায় ১০ লাখ টাকা। বিশিষ্ট অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্ত (১৯৩১-২০১২) সর্বৈবভাবে ছিলেন একজন কুশলী, কৃতবিদ, কর্মতৎপর, সৎ ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী। প্রায় এক যুগ আগে নিজের সহযাত্রী আত্মীয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার উপলব্ধির স্তরে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে পরবর্তীকালে তিনি সর্ববাদী, সাত্তি¡ক সাধনায় নিবেদিত হন। তার ‘আলিঙ্গন’ ছবিতে এ ধরনের একটি চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল আমাদের। রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরক্ত অনুসারী, বেলুড়মঠের নরেন্দ্রপুরের আত্মিক সাধনার সাত্তি¡ক পুরুষ সুভাষ দত্ত ‘মনরে চল নিজের নিকেতনে’ স্বামী বিবেকানন্দের এই ভুয়োদর্শনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সব ধরনের সংকীর্ণতা রহিত সুভাষ দত্ত সর্ববাদী মতাদর্শের ছিলেন। তিনি অকপটে লিখেছেন ‘আমি ধর্মান্ধ নই, আমার ভেতর কোনো সংকীর্ণতা নেই। আমি আজমির শরিফে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। শাহজালাল, শাহ পরাণ, শাহ মোস্তান, হাইকোর্টের মাজার, মিরপুরের মাজার এসব জায়গায় আমি গিয়েছি। টুপি পরে বা মাথায় পাগড়ি দিয়ে ধ্যান করেছি, মোনাজাত করেছি। অমি মিলাদ মাহফিলে শরিক হয়েছি। চার্চে নতজানু হয়ে যিশুর সামনে প্রার্থনা করেছি, গেছি বৌদ্ধ বিহারে।’ ঢাকায় সিনেমার প্রচারপত্র ও আর্ট ডিরেকশন এবং বাংলা উর্দু ছবিতে কৌতুকপ্রদ চরিত্রে অভিনয় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। অসম্ভব অনুসন্ধিৎসু এবং সূ² দৃষ্টির অধিকারী কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটির সব সময় আগ্রহ ছিল সৃজনশীল কিছু করার। জীবনকে যেমন দেখতেন তীক্ষè দৃষ্টিতে তেমনি এর শিল্পিত রূপায়ণেও ভাবতেন বেশি। আর এর জন্য তার পড়াশোনা ও অধ্যবসায় শেষমেশ মেশে সেলুলয়েডের ফিতার ক্যানভাসে জীবনের নিত্যতাকে তুলে ধরার। জানিয়েছেন আমি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুটিং দেখতাম, সাউন্ড লক্ষ করতাম, ক্যামেরার কাজ পর্যবেক্ষণ করতাম। মহিউদ্দিন সাহেব কীভাবে ডিরেকশন দিচ্ছেন তাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করেছি। এর মাঝে ইউসিস বা ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে বই নিয়ে ফিল্মের ওপর পড়াশোনা করেছি। নজরুল ইসলাম বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, পরে পাকিস্তান চলে যান, তিনি অনেক ভালো ভালো ছবি করেছেন। তার সঙ্গে আমি ফিল্মের থিওরিটিক্যাল ব্যাপারগুলো নিয়ে পড়াশোনা করতাম। অনেক সময় সিনে-ম্যাগাজিন বা বইগুলো নিয়ে এসে আর জমা দিতাম না। আমার তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে প্রায়োগিক দিকটা মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। এভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপারটি আমি অল্প বিস্তর জেনে যাই। [‘একজন সুভাষ দত্ত’, মুক্তচিন্তা, ২০০৯, পৃ-৩২] তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মর্মবাণী হলো শিকড়ের কাছে ফিরে আসা। ‘সুতরাং’ ছবিতে তার নিজের অভিনীত চরিত্র সিপাহী জব্বার শহরে ব্যস্ত সব কর্মজীবন ছেড়ে ‘ওরে মন ছুটে চল মধুমতি গায়’, গাইতে গাইতে ফিরেছে গ্রামে। ‘কত ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম অশান্ত মনে আমি ছুটে এলাম ... আমার গায়ের মতো কভু দেখিনি, সে যে আমার জন্মভ‚মি ...’, ‘আলিঙ্গন’র সাধু বাবার মতো সুভাষ দত্ত তার শিল্পকর্মে, ‘বসুন্ধরা’য় সেই মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন। দেশিকোত্তম এই ব্যক্তিত্ব নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় দেখিয়েছেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও সেই অভিনয় সুনামের সুবাদে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের শ্রদ্ধা ও সমীহবোধের কারণে মুক্তি পেয়েছিলেন। নিজের সেই মুক্ত পাওয়ার স্মৃতিকে ‘অরুণোদয়ের অগ্নি সাক্ষীতে’ আনোয়ার হোসেনের অভিনয় জীবনের মধ্যে তুলে ধরেছেন। ‘সুতরাং’ ছবিতে নিজের প্রেমিকা জরিনার মাতৃহারা সন্তানকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেয়ার ঔদার্য মেনে দেখিয়েছেন তেমনি ১৯৭২ সলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসনে রেখেছেন মানবীয় দর্শনের ব্যাখ্যা ও সমাধানের প্রেরণা। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকির ‘গলির ধারের ছেলেটি’র চলচ্চিত্রায়নে (ডুমুরের ফুল) একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্ত্বের ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির এমন কাব্যিক শোক গাথা নির্মাণ করেন যা একটি ধ্রুপদি শিল্পকর্মে উন্নীত হয়। ‘আবির্ভাব’ ও ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে সন্তানময়ী মায়ের আবেগ ও আকিঞ্চন আকাক্সক্ষাকে শৈল্পিক তুলিতে বিমূর্ত করেছেন। তার তাবৎ চলচ্চিত্রেই মানবিক মূল্যবোধের, সমাজ দর্শনের এবং নিবিষ্ট চিন্তা-চেতনার ভাষ্যে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। আজ চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। বিনম্র শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App