×

মুক্তচিন্তা

লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত উদ্যোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০৭:০৬ পিএম

লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত উদ্যোগ
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের কৃষি তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততার সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে সমগ্র কৃষি ব্যবস্থাপনা বা শস্য বিন্যাসে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়। দক্ষিণ-পশ্চিম যশোরে এমনটা দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, দেশের দাকোপসহ দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র ভ‚ভাগের অনেক ভেতর পর্যন্ত লোনাপানি ইতোমধ্যেই ঢুকে পড়েছে। এই সমস্যা উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং কুমিল্লা পর্যন্ত উত্তরদিকে বিস্তৃত হয়েছে এবং আরো উত্তরে বিস্তৃত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছে। চট্টগ্রাম শহর সন্নিকটের হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি হয়ে গেছে। এছাড়া খুলনার সুন্দরবনের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যা ত্রিভুজাকৃতির বঙ্গোপসাগরের শীর্ষবিন্দুতে গাঙ্গেয় মোহনায় অবস্থিত। এই গাঙ্গেয় মোহনার মহীঢাল খুব মসৃণভাবে সমুদ্রে নেমে গেছে। এর ফলে আন্দামান সাগরে উৎপন্ন জলঘূর্ণিঝড়গুলোর উত্তরমুখী যাত্রায় মহীঢালের অগভীরতার কারণে জলোচ্ছ্বাস অত্যন্ত উঁচু হয়ে আসে। সাগরের জোয়ারও অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়। তাই সাগরের লোনাপানি ঢুকে পড়ে উপক‚লভাগে, লবণাক্ত করে তোলে ভূ-অভ্যন্তরের পানিও। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছে ব্যাপক মাত্রায় আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে। অনেকে একে মানবসৃষ্ট কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাইলেও গবেষকরা একে প্রাকৃতিক কারণ হিসেবেই শনাক্ত করেছেন। সুন্দরবনের অন্যান্য গাছও আগামরা ও পাতা কঙ্কালকরণ পোকার আক্রমণের শিকার হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে বাইনের বাগানও। সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ ইতোমধ্যেই পানির উচ্চতাজনিত কারণে লবণাক্ততার শিকার। এদিকে ননিয়ানরেঞ্জ আক্রান্ত হওয়ার মুখে। মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন এবং সেটি আসে খাদ্য ও পানি থেকে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণের পরিমাণ অনেকগুণ বেশি। এই পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য তা হয়ে ওঠে আরো বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হারও বেশি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা শুধু অকাল গর্ভপাতেরই শিকার হন না, ৩ শতাংশ শিশুও মারা যায়। এছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। লবণাক্ততা কমাতে ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা ৮-১০ ফুট নিচে থাকা উচিত। পানি নিষ্কাশনের দ্বারাই পানির উচ্চতাকে সুবিধাজনকভাবে নিচে রাখা। পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য টালি নালা, খোলা নালা, আবৃত্ত নালা, কুয়া থেকে পাষ্প করে পানি বের করে দেয়া যায়। এছাড়া প্লাবন সেচের মাধ্যমে লবণজাতীয় পদার্থগুলোকে পানিতে দ্রবীভ‚ত করা হয় এবং প্লাবনের মাধ্যমে এই দ্রবীভূত লবণগুলোকে ধুয়ে জমি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এরূপ জমিতে সমন্বিত রেখা বরাবর ছোট ছোটভাবে বিভক্ত করে নেয়া হয় এবং প্রত্যেক জমিতে আইল বেঁধে উঁচু করা হয়। এরপর ঢালের আড়াআড়িভাবে ভেলির মতো করে দেয়া হয়। এরপর পানি সেচ করে প্রতিটি জমি ভালোভাবে প্লাবিত করে দিতে হয়। লবণাক্ততার সম্ভাবনাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারি। লবণ সহ্য করতে পারে এমন ধান ব্রি ধান-৪৭ এবং বিনা ধান-৮ কৃষক পর্যায়ে রয়েছে। এ ধান সর্বোচ্চ ১২ ডিএস-এম মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে। দেশের উপক‚ল অঞ্চলে যে হারে লবণাক্ততা দিন দিন বেড়ে চলেছে সেই হারে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। বরং কৃত্রিম উপায়ে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি দ্বারা বাগদা চিংড়ি চাষের ফলে লবণাক্ততা আরো বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে যত দ্রুত লবণাক্ততা দূরীকরণে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় ততই মঙ্গলজনক। শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App