×

মুক্তচিন্তা

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন : চীনের জন্য অশনি সংকেত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০৮:১৬ পিএম

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন : চীনের জন্য অশনি সংকেত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভরাডুবি ঘটেছে। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরপর ভারত ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু চীন প্রতিক্রিয়া জানাতে কালক্ষেপণ করে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ অভিনন্দন জানানোর প্রায় এক সপ্তাহ পর শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানায় চীন। অথচ খবরটিতে তাদেরই সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হওয়ার কথা। মূলত বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) ছড়িয়ে পড়ার পর দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়েছে। এই ঘটনার জন্য ট্রাম্প সরাসরি চীনকে দায়ী করেন। তিনি একে চীনের সুপরিকল্পিত চক্রান্ত বলে বর্ণনা করেন। করোনা ভাইরাস দ্রæত ছড়িয়ে পড়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) গাফিলতিকেও দায়ী করা হয়। ব্যবস্থা হিসেবে ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় চাঁদা প্রদান বন্ধ করে দেন। ফলে এই সংস্থা মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে। কারণ মোট তহবিলের অর্ধেকই আসে চাঁদা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই ঘটনার পর দুদেশের মধ্যকার বাণিজ্যে শুল্কহার বৃদ্ধিসহ চীনের বিরুদ্ধে একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ট্রাম্প। বলতে গেলে বিশ্ববাণিজ্যে চীনকে অবরুদ্ধ করে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরও কেন চীন ট্রাম্পের ভরাডুবি ও বাইডেনের নির্বাচনে খুশি নয় তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। জানা যায়, চীনের ব্যাপারে বাইডেনের নীতি কী হয় তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে তারা। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর যে ভাষণ দেবেন তাতে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এই নির্বাচনকে আরো বড় বিপদ হিসেবে দেখছে চীন। কারণ বাইডেন তার রানিং মেট (ভাইস প্রেসিডেন্ট) হিসেবে যাকে বেছে নিয়েছেন তিনি একজন ভারত বংশোদ্ভ‚ত আমেরিকান। সিনেটর কমলা দেবী হ্যারিস ইতোমধ্যে ভারতের প্রতি তার আবেগের কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে শৈশবে পিতামহের বাড়ি তামিলনাড়ু ভ্রমণের যে স্মৃতিচারণা তিনি করেছেন তাতে স্পষ্ট হয়েছে বাইডেন জমানায় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো মজবুত হবে। বাইডেন চাইলেও কমলা ভারতের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে দেবেন না। কমলার ব্যক্তিত্বের কাছে মার্কিন নেতৃত্বের অনেকেই অসহায়বোধ করবেন। এটাই চীনের জন্য এক মহাউদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাইকে হাত করতে পারলেও কমলা দেবীকে সম্ভব নয়। কারণ তার শিকড় রয়েছে ভারতের মাটিতে। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার ভারতে সফরে এসে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্পর্কিত ‘বেসিক এক্সচেঞ্জ এন্ড কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা ‘বেকা’। এই চুক্তির বলে যুক্তরাষ্ট্রের উপগ্রহ মারফত প্রাপ্ত যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য পাবে ভারত। সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের লক্ষ্যবস্তু নিশানা করতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা এতে বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া ভারতকে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ও ড্রোন সরবরাহ নিয়েও কথা হয়েছে। মূলত চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে এক মহাশক্তিশালী দেশ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যাতে করে সম্প্রসারণবাদী ওই দেশটির হম্বিতম্বি বন্ধ হয়। চীনের বাড়ম্বরতার শুরু ২০১৪ সালের পর। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড়শ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যকে খর্ব করে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নেয় চীন। এটি অবশ্য সামরিক শক্তির নয়, অর্থনীতির। ওই বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে চীন অর্থনৈতিক শক্তিতে বিশ্বের এক নম্বর দেশের তকমা পায়। এই অর্থনীতির নেপথ্যে অবাধ বাণিজ্য। বিশ্বব্যাপী স্বল্পমূল্যে এবং দেখতে আহামরি অথচ নাজুক পণ্য বিপণন করে চীন রাতারাতি বিশ্ববাজার দখল করে নেয়। চীনের এই বাণিজ্যিক আগ্রাসন থেকে চিরবৈরী ভারতও রেহাই পায়নি। গত জুনে লাদাখে ২২ জন ভারতীয় সৈন্য হত্যার আগ পর্যন্ত ভারতীয় বাজার চীনের দখলে ছিল। লাদাখ ঘটনার পর ভারত কয়েকগুণ শুল্ক বৃদ্ধি করে সে দেশে চীনা পণ্য প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। ১৮৭২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল বিশ্বসেরা অর্থনীতি। ২০১৪ সালে চীন অদম্য শক্তিতে সেই শীর্ষস্থান দখল করায় যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আইএমএফের সেদিনের জরিপে আরো দেখানো হয় চীন, যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে ভারত। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে জাপান, পঞ্চমে জার্মানি, এর পরেই রয়েছে রাশিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স ও ইন্দোনেশিয়া। আর সেরা দশে শেষ নামটি যুক্তরাজ্য। চীনের এই অর্থনৈতিক বিস্ফোরণ রুখে দেয়ার অপেক্ষায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। করোনা ভাইরাসের বদৌলতে সেই সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এসে ধরা দিয়েছে। ট্রাম্প এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেননি। তিনি কেবল যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক দেননি, ইউরোপের দেশগুলোকেও তার দলে শামিল করতে সক্ষম হয়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে চীনা পণ্যে গুদাম সয়লাব হলেও ক্রেতা নেই। ফলে চীনা অর্থনীতি আবারো উল্টো দিকে চলতে বাধ্য। এটা ঠিক, সোভিয়েত ইউনিয়নের পর আর কোনো কমিউনিস্ট দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হওয়ার আগে দেশটিকে জমিনে মিশিয়ে দিতে অথবা টুকরো টুকরো করতে যুক্তরাষ্ট্র একটুও পিছপা হবে না। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে তাদের পক্ষে চীনের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করা জটিল। এ কারণে চীনের নানা অপতৎপরতায় চরম ক্ষুব্ধ ও যোগ্য প্রতিদ্ব›দ্বী ভারতকে তারা বেছে নিয়েছে। দেশটি আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে চীনের প্রায় সমান। তাছাড়া সমরশক্তির দিকে থেকে দুদেশের মধ্যে পার্থক্যও কম। এর আগে অবশ্য চীনকে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে পাওয়ার জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ নেই যা ভারতের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। মাত্র এক বছর আগে তামিলনাড়– সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু কট্টর সম্প্রসারণবাদী দেশটির মন ভোলেনি। তারা তাদের অবস্থানে অটল। তারা এই অঞ্চলের মোড়ল দেশের মর্যাদা চায়। কিন্তু বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তির পক্ষে তা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো উপস্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের ৬০টি দেশের সঙ্গে চীনের মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করা। সড়কপথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। এই সড়কপথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও রয়েছে। প্রস্তাবিত এই করিডোর নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। তাদের ধারণা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীন ৬০টি দেশের ওপর তার প্রভুত্ব কায়েম করতে চাইবে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত হবে ভারত। তারা একদিকে চীনের বশ্যতা স্বীকার করতে পারবে না, অপরদিকে চীনের বিরুদ্ধাচরণ করাও কঠিন হবে। কারণ চীন তখন অন্য সব দেশের সমর্থন পাবে। ভারতের আপত্তির প্রধান কারণ হলো, প্রস্তাবিত প্রকল্পের অধীনে চীন যে দুটি ‘ইকোনমিক করিডোর’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে, তার একটি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মিরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চল নিয়ে ভারতের বহুদিনের বিরোধ আছে পাকিস্তানের সঙ্গে। আর দ্বিতীয়ত, এটার অর্থায়ন মোটেও সলিড কোনো খাত থেকে হচ্ছে না। বরং সেটা হবে ‘ডেট ফাইন্যান্সিং’-এর মাধ্যমে, অর্থাৎ এটা সদস্য দেশগুলোর মাথায় বড় ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেবে। এ কারণে ভারত এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারত বেঁকে বসায় চীনের এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা কয়েক ধাপ এগিয়েও এখন থমকে দাঁড়িয়েছে। এতেই চীন মহাখাপ্পা। তারা এখন ভারতকে বিপদে ফেলার জন্য নানা ফন্দির আশ্রয় নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ভুটান আর ভারতের সিকিম প্রদেশের সংযোগস্থলে একটি উপত্যকার ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি করাকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে নতুন করে বিরোধের সূচনা হয়েছে। চীন চায় সেখানে একটি রাস্তা তৈরি করতে। কিন্তু যে জায়গাটিতে চীন রাস্তা তৈরি করতে চাইছে সেটি একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা। সে উপত্যকাকে চীন এবং ভুটান উভয় দেশই নিজের বলে দাবি করে। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ভুটানের পক্ষে। ভারত মনে করে, চীন যদি এ রাস্তাটি তৈরি করে তাহলে কৌশলগতভাবে তারা পিছিয়ে পড়বে। এ রাস্তাটির মাধ্যমে চীন এমন একটি জায়গায় পৌঁছে যাবে যেটি ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। চীন এমন জায়গায় সড়ক নির্মাণ করতে চাইছে যার পাশেই ভারতের ২০ কিলোমিটার চওড়া একটি করিডোর আছে। এ করিডোরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো মূল ভারতের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে। অপরদিকে ভারত মনে করে সিকিম রাজ্যটি তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সিকিম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারত চীনের যে কোনো আগ্রাসনের জবাব দিতে পারে। চীন এ বিষয়টি অনুধাবন করে সেখানেও তাদের কৌশলগত অবস্থান জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে। চীন মনে করে যে জায়গাটিতে তারা সড়ক নির্মাণ করতে চাইছে সেটি তাদের অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড। ভারতে সেখানে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। স্রেফ গায়ের জোরে তারা সবকিছু দখল করতে চাইছে। আর তাদের স্বপ্নের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আর কারো ওজর-আপত্তি শুনতে চাইবে না তারা। ভারত এটা বেশ ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারায় যুক্তরাষ্ট্রের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরতে দ্বিধা করেনি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর ভারত সফরের পর চীন কিছুটা হলেও থমকে গেছে। এখন বাইডেন যদি ট্রাম্পের চেয়ে অধিক সাহায্য-শক্তি নিয়ে ভারতের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তো চীনের প্রকল্পগুলো মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন অর্থনৈতিক পরাশক্তির বদলে দেউলিয়া রাষ্ট্রের তকমা সেঁটে যাবে তাদের ললাটে। ফারাজি আজমল হোসেন : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App