×

সাহিত্য

‘অপসংস্কৃতি রুখতে টিকিয়ে রাখতে হবে শিল্পীদের’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৩৭ এএম

‘অপসংস্কৃতি রুখতে টিকিয়ে রাখতে হবে শিল্পীদের’

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত নৃত্যানুষ্ঠান -ফাইল ছবি

স্থবির জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড- ৪০

সাগর উপকূলীয় জেলা বরগুনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ ভূমি। এখানে প্রকৃতির অপার লীলা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত যেমন মন কাড়ে, তেমনই সবুজ সমারোহের মাঝে হরিণের চারণভূমি হিসেবে সুনাম আছে বরগুনার। মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ এই জেলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও অগ্রগামী।

দেশের সর্ব দক্ষিণের নদীবেষ্টিত জেলা বরগুনার আদিবাহন নৌকা। পায়রা-বিষখালী বিধৌত বরগুনায় রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। বন ও নদী এই জেলাকে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করেছে।

বরগুনা নামকরণ প্রসঙ্গে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলে কাঠ নিতে এসে খরস্রোতা খাকদোন নদী অতিক্রম করতে অনুকূলপ্রবাহ বা বড় গোনের জন্য অপেক্ষা করতেন। সেজন্য এই স্থানের নাম হয় ‘বড় গোনা’। সেখান থেকেই ‘বরগুনা’ নামের উৎপত্তি।

বরগুনার দর্শনীয় স্থানের তালিকায় রয়েছে টেংরাগিরি ইকোপার্ক, রাখাইন পল্লী, পাথরঘাটার হরিণঘাটা, লালদিয়ার চর, সোনাকাটা পর্যটনকেন্দ্র, বিবিচিনি শাহি মসজিদ। এছাড়া পায়রা নদীতে সূর্যোদয় ও ডিসি কার্যালয়ের ইলিশ চত্বর দেখার মতো।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ এই সবুজ জনপদের শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গন করোনার হানায় স্থবির হয়ে পড়েছে।

সূত্র জানায়, বরগুনায় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা ষাটের অধিক। সংস্কৃতিকর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের মতো। যারা সংস্কৃতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তারা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে গেছেন। এদের মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৯০ জনকে দুঃস্থশিল্পী সহায়তা দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ শিল্পীই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনন্যোপায় হয়ে কেউ কেউ প্রিয় হারমনিয়াম আর কি-বোর্ড ও প্রতিষ্ঠানের আসবাবও বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, কেউ বা পেশা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। কেউ কেউ ধার দেনা এবং জমানো টাকা ভেঙে চলছেন। কেউ বা বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছেড়ে চলে গেছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। এমন বাস্তবতায় করোনাকালে শিল্পীদের প্রতি মাসে আর্থিক সহায়তা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।

তবলা শিল্পী, প্রশিক্ষক, গীতিকার ও নন্দন সাংস্কৃতিক একাডেমির পরিচালক অমিত কুণ্ডু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যার লেখা গান ‘জাতির বন্ধু দেশের বন্ধু, প্রাণের প্রিয় বঙ্গবন্ধু’ গান ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। ২০০৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নন্দন সাংস্কৃতিক একাডেমি। এক যুগেরও অধিক বয়সি এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি চরম সংকটের মুখে পড়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।

জানতে চাইলে ভোরের কাগজকে এই শিল্পী বলেন, করোনার কারণে আমার একাডেমি একেবারে চলছিল না। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ ভাড়া চালাতে হচ্ছে। তা আর পেরে উঠছিলাম না। দিশাহারা হয়ে প্রতিষ্ঠানের হারমনিয়াম, কি-বোর্ড, বুক শেলফ, ফ্যান, চেয়ার বিক্রি করে দিয়েছি। তিনি বলেন, সরকারের উচিত যতদিন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যেতে পারছি না, ততদিন শিল্পীদের পাশে থাকা।

তবলা শিল্পী শিপন শীলের কণ্ঠেও ঝরে পড়ল সীমাহীন যন্ত্রণার কথা। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই পেশায় আছি। বিদেশি সংস্থা কুইন্স এডুকেশন মিউজিক অব ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত প্রতিযোগিতায় আমি নৃত্যে প্রথম হয়েছিলাম। অথচ করোনার ধাক্কায় নিরুপায় হয়ে প্রিয় এই পেশা থেকে ছিটকে পড়েছি আমি! টিকে থাকার লড়াইয়ে বাধ্য হয়ে এই পেশা বদলে ফার্মেসির দোকান দিতে হলো। তিনি বলেন, অপসংস্কৃতি রুখতে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঁচিয়ে রাখতে শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে।

নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যালয়ের পরিচালক মো. মেহেদী হাসান বেলাল বলেন, অনুষ্ঠান নেই, টিউশনি নেই। বেকার বসে আছি। শহরে থেকে কুলিয়ে উঠতে পারছিলামও না। কারণ বাসা ভাড়া আর টানতে পারছিলাম না। তাই নিরুপায় হয়ে শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে এসেছি।

নৃত্যশিল্পী দিল আফরোজ তাহরিমা অনেকটা ক্ষোভ ঝেড়ে বললেন, নাচই আমার পেশা। প্রতি মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যথেষ্ট আয় হতো। অথচ করোনায় একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে মুদি দোকান, সবখানেই দেনা হয়ে গেছে। অথচ জেলা প্রশাসনের চাল ডাল তেল ছাড়া আর কোনো সহায়তা পাইনি।

তিনি বলেন, ডিসি স্যারের কোনো প্রোগ্রামে ৩০ হাজার বা ৪০ হাজার টাকা সম্মানি দেয়া হলেও আমাদের দেয়া হয় মাত্র ৫ হাজার টাকা।

সংগীত প্রশিক্ষক জাকির হোসেন পান্না বলেন, অধিকাংশ শিল্পীই এমনিতেই গরিব। তাদের টাকার দিকে অতটা নজর নেই। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সব কিছু বন্ধ থাকায় তারা বেকায়দায় পড়ে গেছে। সরকারের ৫ হাজার টাকা সহায়তা বর্তমান বাজারে কিছুই হয় না। অন্তত করোনাকালী দুর্যোগে সহায়তা অব্যাহত রাখলে শিল্পীরা প্রাণে বাঁচবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরগুনা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মুনীরুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, সংস্কৃতি খাতে এমনিতেই বরাদ্দ কম। যে কারণে সংগঠন প্রধানের কাছেই সম্মানি দেয়া হয়। তিনিই দলের কর্মীদের বরাদ্দ দেন। এক্ষেত্রে শিল্পকলার বলার কিছু নেই। এছাড়া নৃত্যের অনুষ্ঠান করালে নৃত্যের শিল্পীদের ড্রেসের খরচ আমরা দিয়ে দেই। কিন্তু পরে দেখা গেছে, একই পোশাক পরেই তারা অন্য অনুষ্ঠানেও নৃত্য পরিবেশন করছে। এরপর থেকে পোশাকের খরচ না দিয়ে শুধু কস্টিউম খরচই দেয়া হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App