×

মুক্তচিন্তা

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার প্রতি অপার শ্রদ্ধা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৩৫ পিএম

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার প্রতি অপার শ্রদ্ধা

রণদা প্রসাদ সাহা। সমাজে, দেশে-বিদেশে দানবীর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আর পি সাহা নামের আড়ালে কর্মজ্ঞময় মানুষটি যতটা মুঠোভরে অর্জন করেছেন, ততটাই আবার মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার অপার মানবিকতা, সমাজ চেতনা, দেশপ্রেমের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আমাদের। আমি শ্রদ্ধেয় রণদা প্রসাদ সাহাকে কখনো চোখে দেখিনি। কর্মসূত্রে তার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী ভারতেশ্বরী হোমসে যখন এলাম তখন অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে লাগলাম।

রণদা প্রসাদ মানুষকে যা দিয়েছেন, তা ভিক্ষারূপে দেননি, ঋণ হিসেবেও দেননি, দিয়েছেন তাদের প্রাপ্য হিসেবে। বিশ্বাস করতেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই মানব ধর্মে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের লোকহিতের মন্ত্রটিতে নিজের মতো করে দীক্ষিত হয়েছিলেন। যেখানে তিনি বড় হয়েও ছোটর সমান হয়েছেন। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবার অধিকার অর্জন করেছেন। তাকে কাছ থেকে দেখা মানুষদের আলোচনা থেকে জানা যায় ছোটোর জীবনকে সামনে রেখেই তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। আবার সেই অর্থ যখন সর্বসাধারণের জন্য ১৯৪৮ সালে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টে দান করেছেন তখন কোনো আত্মগরিমা তাকে স্পর্শ করেনি। এ জন্যই রণদা প্রসাদ সাহা রণদা প্রসাদ সাহা হতে পেরেছেন। আর সারা জীবন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।

একদিন যে অমানবিক সমাজ রণদা প্রসাদের মা কুমুদিনীর জীবন অকালে কেড়ে নিয়ে ছিল সেই নিষ্ঠুর বর্বর সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আজীবন। এই সমাজের প্রতি তার অপার ঘৃণা ছিল, কিন্তু প্রতিশোধ স্পৃহা পরিণত হয়ে ছিল সমাজ বদলের সংকল্পে। এটা ছিল তার দ্বিতীয় যুদ্ধ। বিনা পয়সায় তৃণমূল মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবা ও মেয়েদের জন্য শিক্ষা পৌঁছে দেয়া। বাস্তবে এ যুদ্ধ ছিল তার জীবন যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। যে সমাজ সংসার থেকে তিনি একদিন উচ্ছেদ হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই সমাজেই ফিরে এসেছিলেন। সমাজ পারলে তাকে একঘরে করে ছাড়ত। বিদেশ যাওয়া, অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়ার অজুহাতে রণদা প্রসাদকে ফিরে যেতে হতো আরো নিষ্ঠুরভাবে, যদি না তার অর্থের জোর থাকত, না থাকত প্রভাবশালী আত্মীয়ের সমর্থন।

সংবেদনশীল রণদা সেই অর্থ-সম্পদ ও সমর্থন নিয়ে সমাজের বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। বড় শহরগুলো থেকে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মির্জাপুরের মতো এক গণ্ডগ্রামে মা কুমুদিনীর নামে দাতব্য চিকিৎসালয় (১৯৩৮) ও একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে। ত্রিশের দশকেই বিনা খরচে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে ভারতেশ্বরী হোমস (১৯৩৮), বাবা দেবেন্দ্র পোদ্দরের নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ (১৯৪২), টাঙ্গাইলে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ করলেন (১৯৪৩)। যদিও পরিস্থিতি ছিল প্রবল প্রতিক‚ল। সেই প্রতিক‚ল অবস্থায় রণদা প্রসাদ পশ্চাৎপদতাকে ধিক্কার না দিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সবটুকু আয়োজন গ্রামের দরিদ্র মানুষদের ঘিরে এবং তাদেরই প্রয়োজনে। এখানেই তিনি অন্যদের তুলনায় এগিয়ে ছিলেন চিন্তা ও চেতনায়।

রণদা প্রসাদ বিপ্লব ঘটিয়ে ছিলেন আরো একটি জায়গায়। গ্রামের অবহেলিত, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কুমুদিনী হাসপাতালে নার্স হিসেবে নিয়োগ দিতেন। সমাজপতিরা যাদের মানুষ বলেই গণ্য করত না সেই সব মেয়েকে তিনি দিয়েছিলেন জীবনকে চিনে নেয়ার পথ। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ, সেই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের সূত্র। যিনি এ রকম একটি কাজ করতে পারেন তার চেয়ে বড় সমাজ বিপ্লবী আর কে? এক্ষেত্রে চরম সাহসেরও পরিচয় দিয়েছেন। তার সংবেদনশীল মনের পরিচয় পাই আরো এটি জায়গায়। কৈশোরে যে সৎমায়ের বৈরী আচরণে তিনি বাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে তার ভেতরেই তিনি একজন বঞ্চিতা নারীর মুখছবি দেখেছিলেন। রণদা প্রসাদ জানতেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান কতটা শোচনীয়। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সেই মায়ের জন্য মনের মধ্যে জায়গা করে দিয়েছেন সম্মানের উচ্চ স্থান।

উপার্জনের ক্ষেত্রে তিনি পুঁজিবাদী কিন্তু সারা জীবন তিনি লড়াই করেছেন পুঁজিবাদের দ্বারা নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। সমাজ বদলের লক্ষ্যে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে রণদা প্রসাদ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানুষের দুই মৌলিক চাহিদাকে বিনা পয়সায় নিশ্চিত করে ছিলেন। সে সুযোগ ধনী-গরিব সবার জন্য সমান ছিল। আকাক্সক্ষাটা সমাজ পরিবর্তনের।

আত্মপ্রচারে উৎসাহী ছিলেন না রণদা প্রসাদ। তিনি জানতেন কাজই তার আত্মপ্রকাশ ও আনন্দ। এখানেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আশা জাগিয়ে ছিলেন। সেই সব মানুষই তাকে ভালোবেসেছে। আজ যারা তাকে চোখে দেখিনি তারাও ভালোবেসেছি তার জীবন ও আদর্শের গল্প শুনে, হয়েছি অনুপ্রাণিত। দানবীর রণদা প্রসাদ ১৮৯৬ সালে ১৫ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বধীনতা যুদ্ধে ৭ মে পুত্র ভবানী প্রসাদকে নিয়ে তিনি বীরের মৃত্যুবরণ করে ছিলেন। মৃত্যুতে তিনি শেষ হয়ে যাননি, রণদা প্রসাদের কর্মময় জীবন, নীতি ও আদর্শ, অপার মানবিকতা, তার সমাজ চেতনা, দেশপ্রেম আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে নিরন্তর। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App