×

মুক্তচিন্তা

ছাদকৃষির ধারণা ও কলাকৌশল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৪৩ পিএম

ছাদবাগান থেকে ছাদকৃষি কথাটি আমার নয়, শাইখ সিরাজের, যিনি দীর্ঘ সময়জুড়ে টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক নানা মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান করে চমৎকৃত করছেন দেশের মানুষকে। তাছাড়া পত্রপত্রিকায়ও সরব আছেন একই বিষয় নিয়ে। তার নিজের ভাষ্য, ১৯৮০ সাল থেকে ছাদে কাজি পেয়ারার গাছ লাগানো দিয়ে প্রচারণা শুরু করেছিলেন তিনি। তখন শহুরে মানুষ মূলত শখ করে ছাদে ফুলের গাছ লাগাতেন, বলা হতো একে ছাদবাগান। এখন বলা হচ্ছে ছাদকৃষি। এই রূপান্তরের কাজটি ব্যাপকভাবে ঘটেছে গত ৫-৭ বছরে। অনেকে মনে করেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আগ্রহীর সংখ্যা বাড়িয়েছে। ঘরে আবদ্ধ থাকা মানুষের একাংশ, যাদের ব্যবহার্য ছাদ আছে, তারা এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলফলাদি ও সবজির চাষে ভরে উঠছে তাদের ছাদ। শখের ফুলবাগানও আছে পাশাপাশি।

একসময় মনে করা হতো গাছগাছালি ছাদের জন্য ক্ষতিকর। ধারণা পাল্টেছে এখন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাদবাগান বা ছাদকৃষি ছাদের জন্য ক্ষতিকারক তো নয়-ই, বরং উপকারী। ভবন ঠাণ্ডা রাখে, সবুজের সমারোহ মনের প্রফুল্লতা বাড়ায়, অক্সিজেনের জোগান দেয়। ছাদের ক্ষতি হয় রোদবৃষ্টিতে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত না হয়ে জমে থাকলে ক্ষতির মাত্রা বাড়ে। দৃষ্টির আড়ালে থাকার কারণেই এমনটি হয়। ছাদবাগান ছাদকে দৃষ্টিসীমার ভেতর রাখে, নিষ্কাশনের দিকে নজর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বদলে উল্টো টেকসই হয়। কেউ কেউ ডেঙ্গু মশার ভয় করেন ছাদবাগানের কারণে। অকারণ ভীতি এটি। নিয়মিত পরিচর্যার কারণে ডেঙ্গুর উপদ্রব বরং নিরোধিত হয় সেক্ষেত্রে।

কী না হয় আজকাল ছাদকৃষিতে! আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, বড়ই, কদবেল, আমড়া, স্ট্রবেরি, মাল্টা, ডালিম, আনার, লটকন, কামরাঙা, লেবু ইত্যাদি; এমনকি ভিয়েতনামের ছোট জাতের নারিকেলের চাষও হয় ছাদবাগানে। আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা ছাদে চাষোপযোগী নানা প্রজাতির আবিষ্কার ও সন্ধান দিয়ে আবাদ সহজ করে দিয়েছেন। আগ্রহী মানুষজন সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের চাহিদা মেটানোয় মনোযোগী হয়েছেন। চেষ্টা করছেন সবজির প্রয়োজনও নিজ উদ্যোগে মেটাতে। কাঁচামরিচ, সিম, লাউ, টমেটো, বেগুন, বিভিন্ন প্রকারের শাক ও অন্যান্য সবজি ছাদে ফলানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেকেই। সফলও হচ্ছেন।

ছাদবাগান ও ছাদকৃষির প্রতি আগ্রহ ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও কল্যাণকর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর দিন দিন ঘিঞ্জি হয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করছে। শহরে খালি জায়গা বলতে গেলে এখনই তেমন নেই, অদূর ভবিষ্যতে তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দালানকোঠার ভারে সবুজ তিরোহিত হচ্ছে ক্রমেই। এ অবস্থায় ছাদবাগান কিছুটা হলেও পরিবেশ অনুক‚লে রাখার সহায়ক হবে। মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে, এখন সেই আগ্রহকে ধরে রাখা ও প্রসারিত করা নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব।

এই দায়িত্ব পালনের প্রবণতা যে একেবারে নেই তা নয়- আছে, তবে দৃশ্যত তা ঢাকা শহরে; যদিও তার বিস্তার প্রয়োজন গোটা দেশে। আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু বিভাগ বা অধিদপ্তর আছে। এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি তথ্য সার্ভিস ছাদবাগান বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে আগ্রহীদের। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছে নবীন উদ্যোক্তাদের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘নগর কৃষি উৎপাদন সহায়ক’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাছাড়া একই বিষয় নিয়ে কাজ করছে ‘গ্রিন সেভার্স’, ‘বাগানবাড়ি’ ইত্যাদি বেসরকারি সংগঠন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ছাদবাগানকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে কিয়ৎপরিমাণ হোল্ডিং টেক্স মওকুফের কথা ভাবছে বলে পত্রিকায় দেখছি। তবে দুর্নীতি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে না পারলে করপোরেশনের ভাবনা ‘গুড়ের লাভ পিঁপড়ায় খাওয়ার’ দশা হবে।

ছাদবাগান বা ছাদকৃষির উপযোগিতা প্রশ্নাতীত। ফলের উৎপাদন-বর্ধন-পাকানো এবং বিভিন্ন রকম সবজির চাষে প্রায়ই এমন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যা স্বাস্থ্যহানিকর। তাছাড়া আমদানি করা ফলকে পচাগলা থেকে রক্ষার জন্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে ছাদকৃষি পরিত্রায়ক হতে পারে। নির্বিষ ফল-সবজি উৎপাদিত হতে পারে সেখানে। এর জন্য প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞান। এই কারিগরি জ্ঞান দেয়ার ক্ষমতা রাখেন আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রকম উদ্ভাবন দ্বারা তাদের সক্ষমতার প্রমাণ ইতোমধ্যে রেখেছেন। ছাদ কৃষির প্রসারে তাদের ভ‚মিকা অগ্রগণ্য হতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তর বা বিভাগের কার্যক্রম সারাদেশে বিস্তৃত। তাদের তৎপরতা গুণে ছাদকৃষির প্রচলন দেশব্যাপী হতে পারে। আগ্রহের বিস্তার ঘটানোর জন্য গণমাধ্যম বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ প্রচারণা ও উৎসাহ প্রদানে শামিল হলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

সবাই অবহিত আছেন, বাংলাদেশে মানুষের তুলনায় ঊমি অনেক কম। নতুন নতুন ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোর কারণে কৃষিজমি প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কমছে। এদিকে বাড়ছে ফলফলাদি ও সবজির চাহিদা। ছাদকৃষি এর কিঞ্চিত সমাধান হতে পারে। আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নারীসমাজ ছাদকৃষির ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। তাদের সফলতার বার্তা পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে প্রায়ই। এটি আশার দিক। জনসমষ্টির একটা অংশ কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় অবসর জীবনযাপন করেন। তারা এ কাজে যুক্ত হতে পারেন ছাদের মালিক হলে। দেশের গ্রাম এখন আর আগের মতো নেই। দালানকোঠা বাড়ছে সেখানে। প্রবাসীর সংখ্যা যে গ্রামে বেশি সেখানে পাকা ভবনও বেশি। কাজেই গ্রামের দিকেও দৃষ্টি দেয়া দরকার। ভ‚মি সেখানেও কম। গ্রামের স্ত্রী-পুরুষ কায়িক পরিশ্রম বেশি করতে সক্ষম। ছাদকৃষির ধারণা ও কলাকৌশল তাদের কাছে পৌঁছলে অধিকতর সুফল পাওয়া যাবে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App