×

সাহিত্য

আর্থিক সহায়তা পেলে বাঁচার পথ খুঁজে পাব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১০:২৮ এএম

আর্থিক সহায়তা পেলে বাঁচার পথ খুঁজে পাব

ফাইল ছবি

স্থবির জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড -৩৯

সবুজ মাঠ গাছ-গাছালি, নদী-নালা, খাল-বিল, অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিপাটি জেলা ঝালকাঠি। কবি জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার ধানসিঁড়ি নদী এই জেলায় অবস্থিত। এর আছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। জেলাটি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত হলেও এর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সুগন্দা, বিষখালী ও ধানসিঁড়ির মতো নদী এই জেলার বুক চিরে প্রবাহিত।

ঝালকাঠি জেলার নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এখানকার জেলে সম্প্রদায়ের ইতিহাস। মধ্যযুগ-পরবর্তী সময়ে সন্ধ্যা, সুগন্ধা, ধানসিঁড়ি ও বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকায় জেলেরা বসতি স্থাপন করে। এর প্রাচীন নাম ছিল ‘মহারাজগঞ্জ’। ভূ-স্বামী শ্রী কৈলাশ চন্দ্র এখানে জমিদারি বৈঠক সম্পাদন করতেন ও পরবর্তী সময়ে তিনি এই স্থানে একটি বাজার গড়ে তোলেন। এই গঞ্জে জেলেরা জালের কাঠি বিক্রি করত। এ জালের কাঠি থেকে পর্যায়ক্রমে ‘ঝালকাঠি’ নামকরণ হয় বলে অনেকের ধারণা।

ঝালকাঠি জেলার ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে- রাজাপুর সাতুরিয়া জমিদার বাড়ি, কবি জীবনানন্দ দাশের মামা বাড়ি, কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ি, সিদ্ধকাঠি জমিদার বাড়ি, শিববাড়ি মন্দির ও ঠাকুরবাড়ি, শেরে বাংলার নানা বাড়ি। এছাড়া অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ধানসিঁড়ি নদী, রূপসা খাল, পোনাবালিয়া মন্দির, বেশনাই মল্লিকের দীঘি। এছাড়া ঝালকাঠি জেলাকে শিল্পসমৃদ্ধ জেলায় রূপায়িত করেছে শীতল পাটিশিল্প, মৃৎশিল্প, তাঁতশিল্প ও পান বরজ। কিন্তু শিল্পসমৃদ্ধ এই জেলায় ঢুকে পড়েছে করোনা। এর ছোবলে শিল্প, সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে স্থবিরতা।

সূত্র জানায়, ঝালকাঠিতে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা পঞ্চাশেরও অধিক। সংস্কৃতিকর্মীর সংখ্যা ৩ শতাধিক। যাদের অনেকে সংস্কৃতিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। যারা বিভিন্ন মঞ্চের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি নানা অনুষ্ঠান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আজ তারা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে গেছেন। এদের মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৫০ জনকে ৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। বাকি অনেকের জীবন কাটছে দুঃসহ কষ্টে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার থাবায় অধিকাংশ শিল্পীই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনন্যোপায় হয়ে কেউ কেউ ধার দেনা এবং জমানো টাকা ভেঙে চলছেন। কেউ কেউ একেবারে পেশা ছেড়ে দেয়ার কথাও ভাবছেন। করোনাকালে এসব শিল্পীদের প্রতি মাসে ৫ হাজার করে আর্থিক সহায়তা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।

জানতে চাইলে লোক সংগীতশিল্পী শুভ বেপারি ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের পরিবারের সবাই সংগীতশিল্পী। সবাই এখন বেকার বসে আছি। করোনার মধ্যে দুটো ঈদ গেল, পহেলা বৈশাখ গেল, পুজো গেল। এসব উৎসবে অংশ নিয়ে ভালোই আয় হতো। কিন্তু এবার কোনো উৎসবই ধরতে পারলাম না। এমনকি কালী পুজো নিয়েও নানা আয়োজন হতো। তাও এবার হচ্ছে না। গানের টিউশনি করতাম, তাও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এমন বাস্তবতায় অল্প কিছু জমানো টাকা ছিল তা ভেঙে কিছুদিন চলেছি। এখন একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেছি।

আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় লোক গানে তৃতীয় স্থান পাওয়া এই শিল্পী আরো বলেন, হাজারো দর্শকের মাঝে গান গেয়ে বাহ্বা পেয়েছি। অথচ এই দুঃসময়ে কেউ খোঁজও নিল না! অনেক সময় ২ বেলা না খেয়েও ছিলাম। এমনকি একদিন বাসার পাশ থেকে কলমি শাক তুলে সবাই ভেজে খেয়েছি। তারপরও লজ্জার কারণে কারো কাছে মুখ খুলে কিছু বলতে পারিনি। এখনো সে কষ্ট যাচ্ছে না। গান করার সময় চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে! গান আমার রক্তে মিশে গেছে। সামনে আরো ভয়ানক পরিস্থিতি আসলেও গান ছাড়ব না। একটু আর্থিক সহায়তা পেলে বাঁচার পথ খুঁজে পাব। নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করব। এই দুঃসময়ে কেউ আমাদের পাশে থাকবেন?

শিল্পী নাসরিনের কণ্ঠেও ধ্বনিত হলো ব্যথাভরা দীর্ঘশ্বাস। সারা বাংলাদেশে লোক গানে তৃতীয় স্থান পাওয়া এই শিল্পী বলেন, জীবনটা চোখের পলকেই থমকে গেল। এর থেকে উদ্ধার পাচ্ছি না। এর মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসনের সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু তাতে কিছুটা সহায়তা হয়েছে বটে। কিন্তু থমকে থাকা জীবন এখনো সচল হলো না। কারো কাছে হাত পাতব এমন সুযোগও নেই। নিরুপায় হয়ে চুপ থাকতে হচ্ছে।

নৃত্যশিল্পী রাকিব বলেন, টিউশনি বন্ধ, অনুষ্ঠান বন্ধ, কেবল বন্ধ নেই জীবনের চাহিদা। এর মধ্যে অনেক ধার কর্জও করে ফেলেছি। অনেক আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ৫ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কত দিনই বা চলবে? এমন পরিস্থিতিতে সহায়তা না পেলে বাঁচাই মুশকিল হয়ে যাবে।

ঝালকাঠি কবিতা চক্রের সাধারণ সম্পাদক মু. আল আমিন বাকলাই বলেন, এমনিতেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনটা নাজুক। তার মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যে সহায়তা করেছে তা নানা প্রতিবন্ধকতা আর চড়াই উৎড়াই পেরিয়েই পেতে হয়েছে। এই টেবিল থেকে সেই টেবিল ঘুরতে হয়েছে শিল্পীদের। সরকারি সহায়তা আসার পরও পুনরায় অনুসন্ধান করে তারপর শিল্পীদের হাতে টাকা দিয়েছে। এর মধ্যে যারা প্রত্যন্ত এলাকায় থাকে তারা এখনো সহায়তার বাইরেই রয়ে গেছে।

সংগীত প্রশিক্ষক দেবাশীষ সেনগুপ্ত বলেন, নৃত্য থেকে শুরু করে সংগীতের, গিটারের সব টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে বেকায়দায় পড়ে গেছেন। কারণ অনেকেরই এটাই পেশা। তারা লজ্জায় হয়ত কারো কাছে বলতেও পারছেন না। কিন্তু মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

করোনাকালে শিল্পীদের জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা সহায়তার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এই সংকটে সরকারের দেয়া ৫ হাজার টাকা শিল্পীদের কোনো কাজেই আসেনি। কারণ এখন কার্যত সবই বন্ধই রয়েছে। কিন্তু জীবনের চাকা থেমে নেই। তাই শিল্পীদের প্রতি মানবিক হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নইলে শিল্পাঙ্গন একেবারে শেষ হয়ে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App