×

মুক্তচিন্তা

শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে মুক্তিই নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৪১ পিএম

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যে শুধু পাঁচজন শ্বেতাঙ্গের তিনজনই ভোট দিয়েছে, তা-ই নয়। অভিবাসীদের একটা অংশও ট্রাম্পকে পছন্দ করেছেন আমেরিকার ঐতিহাসিক এ নির্বাচনে। অথচ কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী, সম্প্রদায়গত দ্ব›দ্ব উসকে দেয়া, ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়েই তিনি কাটিয়েছেন তার গত চারটি বছর। শুধু তাই নয়, নারী নিগ্রহের মতো ব্যাপারও আছে তার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে। তবুও দেখা গেছে, এমনকি বাংলাদেশি অভিবাসীদের কেউ কেউ, অনেকেই তাদের স্বাধীন মত প্রয়োগে ট্রাম্পের পক্ষ নিয়েছেন। এমনকি ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, নিজে ভোট দিয়েছেন, প্রকাশ্যেই সে কথাটি উচ্চারণও করেছেন, দোয়াদুরুদও করে সোশিয়েল মিডিয়ায় ছেড়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ট্রাম্পের পক্ষ নেয়াকে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রভাবক হিসেবে অনেকেই চালিয়েছেন, এমনকি দেখা গেছে সোশিয়েল মিডিয়ায় আমেরিকা প্রবাসী কেউ কেউ রীতিমতো তর্ক জুড়েছেন, কেনই ট্রাম্প বিজয়ী হবেন না, এই নিয়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশি রাজনীতির মগ্ন কিছু মানুষ মনে করেছে ডেমোক্রেটের জো বাইডেনের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেই যেতে পারে, তাই তাদের ভেতরে ভেতরেও একটা সন্তুষ্টি কাজ করতেই পারে।

নিজস্ব মতামত প্রয়োগে কোনো বাধা নেই। এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্বের কারণে এবার পৃথিবীর প্রবল প্রভাবশালী ট্রাম্পের সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলেনি এমনকি আমেরিকা তথা বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়া। গণমাধ্যমগুলো সাহস করেছে, এমনকি ট্রাম্পের মিথ্যা ভাষণের লাইভ প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। সেজন্য গণমাধ্যমকে ফেইক বলেছেন, এমনকি তার প্রিয় মাধ্যম ‘টুইটকে’ও তিনি নিয়ন্ত্রণহীন বলে সমালোচনা করেছেন। নির্বাচনে পরাজয়ের আভাস তাকে মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণহীন করে তোলেছে। অভিবাসন নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ঘোষণায় তিনি মূলত অভিবাসনবিরোধী মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছেন অনেক আগেই। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লুয়েডের নিহত হওয়ার পর তিনি আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন, কারণ তিনি তা সামাল দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। ট্রাম্প শুধু তার দেশের ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর হৃদয়ে আঘাত করেননি, তিনি বিভিন্ন সময় তার কথা দিয়ে আহত করেছেন সাংবাদিকদের, তার নিজস্ব মানুষদের। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ক’দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মেডিকেল অফিসার ফাউচিকে তিনি এমনকি জনসমক্ষে অপমান পর্যন্ত করেছেন। সর্বোপরি একজন ‘বেয়াদব’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতেই।

আমেরিকার গত নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন মিডিয়ায় অনেকটা ঘোষিতই হয়েছিলেন যে, তিনি বিজয়ী হচ্ছেন, অথচ ফলাফল উল্টো হয়ে যায়। নির্বাচনের সে ফলাফল নিয়ে বিতর্কও উঠেছে, কিন্তু হিলারি পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সত্য হলো, ট্রাম্প ২০২০-এর নির্বাচনের শুরুতেই এক ধরনের ঘোষণা দিয়ে দিলেন ‘আমি বিজয়ী হচ্ছি, আমি হেরে গেলে আমাকে প্রতারণা করেই হারিয়ে দেয়া হবে’। আমেরিকার মতো ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দেশের একজন প্রেসিডেন্টের এ রকম উক্তি শুধুই অনৈতিক উক্তি নয়, রীতিমতো অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। এই অনৈতিক মানুষটি শুধু তার দেশের দীর্ঘকালের ঐতিহ্যকে ধূসরিত করেননি, এসব বলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ম্লান করে দিয়েছেন।

গত ১০০ বছরের ইতিহাসে এ রকমের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নেই আমেরিকার। এত বিপুলসংখ্যক ভোটার ভোট দিতে বেরিয়ে আসেনি ইতোপূর্বে। এই জায়গাটাতেও কিন্তু ট্রাম্পের অবদান স্বীকার করে নিতে হয়। কারণ বিপুলসংখ্যক অভিবাসী, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী কিংবা উদার গণতন্ত্রী সংখ্যাগরিষ্ঠ অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী আমেরিকানরা চেয়েছে পরিবর্তন, ট্রাম্প থেকে মুক্তি। তাই তারা বেরিয়ে এসেছে এবং ভোট দিয়েছে। সেজন্যই পরিবর্তনের দিকে গেছে আমেরিকা এই নির্বাচনে। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো বিপুলসংখ্যক আমেরিকান ট্রাম্পের এত বেয়াদবি, তার শালীনতা বর্জিত আচার-আচরণকে তোয়াক্কা না করেই তার পক্ষ নিয়েছেন এবং সেজন্যই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়েই ট্রাম্পের আপাতত অন্তর্ধান হয়েছে।

ট্রাম্পের পার্টি রিপাবলিকানরা যতটা না অজনপ্রিয়, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তায় ফাটল ধরেছে এ দলটি শুধু ট্রাম্পের কারণেই। কারণ এতে যতটুকু না দলটির রাজনৈতিক ব্যর্থতা, তার চেয়ে বেশি ব্যর্থতার কারণ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ত্রুটি। তিনি তার চার বছর ধরে বিভিন্ন মন্তব্য করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিতর্কিত এবং সমালোচিত হয়েছেন, পার্টিকেও করেছেন সমালোচিত, বিতর্কিত। আমেরিকার মানুষ মনে করছে মহামারি করোনা ভাইরাসকে গুরুত্ব দেননি ট্রাম্প, সারা পৃথিবী যখন মাস্ক ব্যবহারকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে তা পরিধানে তিনি এখনো অনীহা দেখাচ্ছেন, এটা এক ধরনের অসম্মান জাতির প্রতি। করোনাকালীন কঠিন সময়ে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারাটাও তার ভুলের মাঝে একটা।

যেভাবেই হোক যদি কোনো অঘটন না ঘটান ট্রাম্প, অর্থাৎ তার মামলা-মোকদ্দমা যদি দীর্ঘমেয়াদি না হয়, পরাজয়টা মেনে নেন, তাহলে জানুয়ারির ২০ তারিখই ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ যে উচ্ছ্বাস কিংবা আকাক্সক্ষা নিয়ে টাম্প থেকে মুক্তি চেয়েছে, তা হয়তো পেয়েছে। কিন্তু আমেরিকা অর্থাৎ ট্রাম্পের সেই ‘গ্রেট আমেরিকা’ থেকে কি মুক্তি পাবে এ বিশ্ব? অনেকেই বলে থাকেন, ট্রাম্প যুদ্ধ বাধাননি। কিন্তু তিনি কি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছেন? ইরানের সেনাপ্রধানকে হত্যা করার কথা তিনি অস্বীকার করেননি। ট্রাম্প সৌদি আরব কিংবা আরব আমিরাতকে নাকে খত দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে প্রধান ভ‚মিকা পালন করেছেন, কিন্তু ফিলিস্তিনের সমাধান করেননি। অর্থাৎ মুসলিম জাতির মাঝে একটা আন্তঃযুদ্ধ তিনি বাধিয়ে চলে যেতে পেরেছেন। ইসলামোফোবিয়ার বীজ তিনি রোপণ করেননি, তবে এই ফোবিয়াকে তিনি বিকশিত করেছেন। আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্টই এই ফোবিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, পারেননি এমনকি বারাক ওবামাও।

সুতরাং বাইডেন তো আমেরিকারই প্রেসিডেন্ট। সন্ত্রাস-টেরোর প্রভৃতি শব্দ কোনোদিনই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিলুপ্ত হবে না। ট্রাম্প হয়তো বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো জর্জ ফ্লুয়েড দিয়ে যে বর্ণবাদী বিদ্বেষ তিনি আমেরিকায় জিইয়ে রেখে গেছেন, তা থেকে আমেরিকাকে কি মুক্ত করতে পারবেন জো বাইডেন? সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন কোভিড নাইনটিন। ট্রাম্প করোনা সংকট মোকাবিলায় আমেরিকার জনসাধারণের কাছে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এখনো হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন শুধুই আমেরিকায়। বিশ্বব্যাপী এ চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়েই বাইডেন এসেছেন বিশ্বের প্রধান নেতা হয়ে। সে কারণে শুধু তার দেশই নয়, করোনা থেকে মুক্তির চ্যালেঞ্জটাও বাইডেনকে নিতে হবে এই সংকটজন সময়ে। নির্বাচনকালীন সময়ে জলবায়ুর বিষয়টাকে শীর্ষ ইস্যু হিসেবে তিনি জলবাযু পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবেন এই আশাবাদ শুধু আমেরিকার নয়, সারা বিশ্বের। আশাবাদী আমরা। আমেরিকার ভেতরের সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি বাইডেন বিশ্বকে বাসযোগ্য করতে উদ্যোগী হবেন।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App