×

সাময়িকী

বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২০, ০৭:৫৮ পিএম

বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র

হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনের এক কালজয়ী নক্ষত্রসম লেখকের নাম। তিনি কালজয়ী মানুষও ছিলেন। তিনি যখন গল্প লিখেছেন- মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তিনি যখন উপন্যাস লিখেছেন- মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তিনি যখন নাটক নির্মাণ করেছেন- মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তিনি যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন- মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। যখন যেখানে হাত দিয়েছেন, নিজের সোনালি হাতের স্পর্শ দিয়েছেন, সবটুকু বাংলার মানুষ গ্রহণ করেছে পরম মমতায়, পরম ভালোবাসায়। ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে পাঠকের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, প্রথম বই দিয়েই পাঠক তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় বই ‘শঙ্খনীল কারাগার’ বের হবার পর হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন, বাংলা কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ এক বিস্ময়কর নাম, এক জাদুমাখা হাত তার। তিনি শুরুতে জানান দিয়েছেন কীভাবে গল্প লিখতে হয়, কীভাবে গল্পকে গল্প করে তুলতে হয়।

আমরা জানি, লেখকমাত্রই- যদি তিনি বড়ো লেখক হন- দুরূহ আর কঠিন কাজটি সবার জন্য সহজবোধ্য করে তুলতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। তিনি বাংলা কথাসাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলা ছোটগল্পে তিনি নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেছেন তার অসামান্য সব গল্প দিয়ে। সাহিত্য সমালোচকরা হুমায়ূন আহমেদের নানা সীমাবদ্ধতার কথা বললেও তার ছোটগল্প নিয়ে কোনো সংশয় নেই তাদের। পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ সমানতালে তার উপন্যাস দিয়েও পাঠককে বই পড়ার প্রতি আগ্রহটা নতুন করে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ নাটক, শিশুসাহিত্য, রম্য, ফিকশন, অতিপ্রাকৃত রচনা, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ-সাহিত্যের সব শাখায়ই স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন এবং নিজের মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। তিনি দীর্ঘ প্রায় ৪ দশকেরও বেশি বাংলার পাঠক সমাজকে নিজের কলমের জাদুতে একরকম মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন। জাদুকর যেমন তার হাতে থাকা কালো ছড়ি বা লাঠি ঘুরিয়ে দর্শকদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায়, হুমায়ূন আহমেদও তেমনি নিজের হাতে থাকা কালো কলমটি সাদা কাগজের ওপর ঘুরিয়ে আমাদের বারবার স্বপ্নের জগতে নিয়ে গেছেন। তিনি একাধারে রচনা করেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক এবং গান। প্রথম উপন্যাসেই বাজিমাত করা লেখকের দেখা পাওয়া গোটা পৃথিবীতেই অনেক দুষ্কর। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হলে সেটিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি তার জীবনকালে ২০০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। মজার বিষয় তার সব বই বাংলাদেশের বেস্ট সেলার বা সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

ছোটদের জন্য তার লেখা ‘পুতুল’, ‘নুহাশ এবং আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ’, ‘হিমুমামা’, ‘ভয়ংকর ভুতুড়ে’ ‘একি কাণ্ড’, ‘অন্যভুবন’, ‘পিপলী বেগম’, ‘বোতল ভ‚ত’, ‘রাক্ষস খোক্কস এবং ভোক্কস’ ও ‘ভ‚ত ভ‚তং ভ‚তৌ’-প্রতিটি বই যেন স্বপ্ন জাগানিয়া। প্রতিটি বই যেন আশ্চর্য মজার জগৎ। প্রতিটি বই যেন হাসিখুশির খোরাক। প্রতিটি বই যেন কল্পনাশক্তিকে ঝালিয়ে নেওয়ার এক মহৌষধ।

মিসির আলির গল্প অন্যভুবন। পাঠকমাত্রই ইঁচড়ে পাকা এবং তারা ইতিমধ্যেই মিসির আলির রহস্যময় সব গল্পের সঙ্গে পরিচিত। মনের রহস্য এবং পার্থিব জীবনের রহস্য মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে মিসির আলির অনবদ্য কাহিনীগুলোয়। এক দুপুরে বরকতউল্লা সাহেব আসেন মিসির আলির কাছে। সমস্যা, তার মেয়ে তিন্নিকে নিয়ে। গাছেরা নাকি তিন্নিকে ডাকে। তিন্নি নিজেও নাকি গাছ হয়ে যাবে! অবিশ্বাস্য এক গল্প! কী নিখুঁত তার বলার ভঙ্গি। এ তো হুমায়ূন আহমেদেরই কারসাজি!

‘রাক্ষস’ আর ‘খোক্কস’ আমরা কমবেশি সবাই চিনি। কিন্তু ‘ভোক্কস’কে কেউ চেনে বলে তো মনে হয় না! ভোক্কস কাজ করে এক প্রকাশনা সংস্থায়, প্রুফ রিডারের কাজ করে। বানান ভুল দুচোখের বিষ তার। ভুল চোখে পড়লেই ওই ভুলসর্বস্ব কাগজ তো কাগজ, পুরো বই গড়গড়িয়ে খেয়ে নেয় ভোক্কস! বইয়ের ভ‚মিকায় হুমায়ূন আহমেদ পরিষ্কার করে দিয়েছেন, বইটির নাম দেখে মনে হতে পারে রূপকথার গল্প। তা কিন্তু না। রূপকথার এক নায়ককে ব্যবহার করে এই সময়ে গল্প বলেছি।

‘ভ‚ত ভ‚তং ভ‚তৌ’ নামের চারটি গল্পের একটি বইয়ে হুমায়ূন আহমেদ ভ‚মিকায় লিখেছেন, তার সারমর্ম হলো- একবার হুমায়ূন আহমেদের করলেন কি, রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। রাগ করলে সবাই খুব ছেলেমানুষ হয়ে যায়... রাত কাটল কমলাপুর রেলস্টেশনে... ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শরীর অবসন্ন। তার চেয়েও বড়ো কথা আসার সময় বাড়িতে দেখে এসেছেন মেয়েটি জ্বরে কাতর। বেচারির কথাও খুব মনে পড়তে লাগল। এসব ভুলে থাকার জন্য গল্প ভাবতে শুরু করলেন লেখক। চারটি গল্প এভাবে তৈরি হলো... বাসায় ফিরলেন দুদিন পর... মেয়ে বিছানায় শুয়ে। তার জ্বর ১০৫-এর কাছাকাছি...মেয়েকে খুশি করার জন্য তার বিছানার পাশে বসে গল্পগুলো লিখলেন। এক এক প্যারা লেখা হয়, সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ে... সে যখন গল্প পড়তে পড়তে খিলখিল করে হাসে। তখন আনন্দে হুমায়ূন আহমেদের চোখে পানি আসে। গোবর বাবু, বড়োমামা বা রাজকুমারী সুবর্ণরেখা, নিউটনের ভুল সূত্র এবং নিমধ্যমা নামের এই চারটি গল্প কোনোদিন ভোলার মতো নয়। তরুণদের উপর হুমায়ূন আহমেদের ছিল জাদুকরি এক প্রভাব। তার সৃষ্ট চরিত্র হিমুকে অনেক সময় লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় মনে করা হয়ে থাকে।

অনেক তরুণই তাদের কৈশোরের কোনো না কোনো সময়ে নিজেকে হিমু হিসেবে কল্পনা করে থাকে। হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি, খালি পা, ভবঘুরে জীবন তরুণদের দারুণভাবে উদ্বেলিত করেছিল। এছাড়াও মিসির আলির মতো রহস্যময় চরিত্র, শুভ্রর মতো অতি পবিত্র চরিত্র তারই সৃষ্টি। বাংলাদেশের কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা লেখকও তিনি। তিনি টেলিভিশনে প্রচারের জন্যও বেশকিছু নাটক এবং টেলিফিল্ম রচনা করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম টিভি নাটক ‘প্রথম প্রহর’ তাকে সারাদেশে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। এ ছাড়াও এসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, তারা তিনজন, উড়ে যায় বকপক্ষী এমন বেশকিছু অত্যন্ত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকের রচয়িতা তিনি। তার নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এ প্রধান চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হলে সেই ফাঁসি বন্ধে সারা দেশের মানুষ মিছিল নিয়ে নেমে পড়েছিল। ঢাকার গলিতে গলিতে পোস্টার লাগানো হয়েছিল। একজন মানুষের সৃষ্টি কতটা প্রভাব বিস্তার করলে এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। মৃত্যুর পর তার নির্মিত ধারাবাহিক নাটক আজ রবিবার ভারতের বিখ্যাত চ্যানেল স্টার প্লাসে হিন্দিতে ডাবিং করে বর্তমানে প্রচারিত হচ্ছে।

বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি একাধারে চলচ্চিত্রকার এবং পরিচালক। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘আগুনের পরশমণি’। তার নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে একটি। তার ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তার পরিচালনায় সর্বশেষ সিনেমা ছিল ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। তার সিনেমাগুলো বেশ কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বেশকিছু বিভাগে পুরস্কার জিতেছিল। তিনি সেভাবে গান রচনা করতেন না। শুধুমাত্র নিজের সিনেমা এবং নাটকের জন্যই তিনি গান রচনা করতেন। তার সিনেমাগুলোর সব গানই মোটামুটিভাবে তিনি নিজেই রচনা করতেন। গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল সেসময়।

আজ আমাদের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই। কিন্তু তার কথা, তার চিন্তা, তার গল্প, তার জাদু এখনও আমাদের সঙ্গে আছে। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক রাজপুত্র। বাংলা সাহিত্যের এক নতুন সূর্য ছিলেন হুমায়ূন। সবচেয়ে তেজী সূর্য বললেও খুব বেশি বলা হয় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App