×

জাতীয়

দেশে দৈনিক ৬৭ শিশুর মৃত্যু নিউমোনিয়ায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪৬ এএম

দেশে দৈনিক ৬৭ শিশুর মৃত্যু নিউমোনিয়ায়

শিশু- ফাইল ছবি

তিন পদক্ষেপে কমতে পারে এই মৃত্যু ৫২ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে সেবা না পেয়ে

পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। এমনকি বৈশি^ক করোনা মহামারির চেয়েও প্রতিরোধযোগ্য এই রোগে শিশু মৃত্যুর হার বেশি। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, দেশে বছরে ২৪ হাজার ৩০০ এবং দৈনিক ৬৭ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে নিউমোনিয়ায়। বিডিএইচএসের ২০১১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল নিউমোনিয়া। প্রতিষ্ঠানের ২০১৭-১৮ সালে প্রতিবেদনেও ওই একই কারণের কথা উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সি ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে দেশে ৪ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গড় হিসাব করলে দৈনিক ১৫ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৬৭ জনের হিসাব ধরে ওই একই সময়ে নিউমোনিয়ায় ৫ বছরের কম বয়সি ৫৩৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিডিএইচএসের তথ্য বলছে, দেশে নিউমোনিয়ায় যে সংখ্যক মৃত্যু হয় এর ৫২ শতাংশই মারা যাচ্ছে বাড়িতে এবং কোনো ধরনের চিকিৎসা না পেয়ে। ৪৫ শতাংশের হাসপাতালে যাবার পর এবং ৩ শতাংশ শিশু একবার না একবার চিকিৎসাসেবা পাবার পর মৃত্যু হয়। বয়স বিভাজনে ১ থেকে ১১ মাস বয়সের শিশুদের মধ্যে মৃত্যু হার বেশি। দেশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের আওতায় এসেছে ৬৫ শতাংশ, টিকাদানের আওতায় ৯০ শতাংশ এবং এন্টিবায়োটিকের আওতায় এসেছে ৬৩ শতাংশ শিশু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা ভাইরাসে যে সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে নিউমোনিয়ায়। অথচ নিউমোনিয়া প্রতিরোধের বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ততটা পাচ্ছে না। তারা বলছেন, নিউমোনিয়া কেবলমাত্র একটি অসুখ নয়, নানামুখী শারীরিক জটিলতা থেকে এই রোগ হয়। দেশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের হার, এন্টিবায়োটিক ও টিকাদানের আওতা এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানো হলে নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। কেউ কেউ আবার পরিবেশ দূষণ এবং মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিকেও নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে মনে করেন।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের কারণে নিউমোনিয়া হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে শিশুদের ফুসফুস পুঁজ ও তরলে ভরে যায়, যার কারণে তাদের নিঃশ্বাস নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রচেষ্টা জোরদার করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ১ লাখ ৪০ হাজার শিশুকে নিউমোনিয়া ও অন্যান্য বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যেতে পারে।

ওই সময় এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, সব চেয়ে দরিদ্রবঞ্চিত শিশুরাই নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে সব থেকে বেশি। ধনী পরিবারের শিশুদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেক এবং তাদের ৫ বছরের জন্মদিনের আগেই মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও দ্বিগুণ। ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রবি বিশ্বাস জানান, দেশে যেসব শিশু বদ্ধ ঘরে ও ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে থাকে এবং গ্রামের শিশুদের চেয়ে শহরের শিশুরা বেশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর প্রধান কারণ ঘনবসতি ও বায়ুদূষণ।

চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণত বেশির ভাগ নিউমোনিয়া হয় এডেনোভাইরাস, রাইনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস, প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দিয়ে। ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ার মধ্যে স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি, হিমেফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস অন্যতম। তবে গবেষকরা বলছেন, দেশে এখনো পর্যন্ত ৫০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার কারণ জানা যায় না। বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসকে সামনে রেখে গতকাল বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএইডের সহায়তায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) রিসার্চ ফর ডিসিশন মেকার্স (আরডিএম) প্রকল্প এবং ডাটা ফর ইম্প্যাক্ট (ডিফরআই) এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় শিশু বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা, আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের জেষ্ঠ্য পরিচালক ড. শামস এল আরেফিন, জেষ্ঠ্য বৈজ্ঞানিক ড. মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী, আইসিডিডিআরবির সহযোগী বৈজ্ঞানিক ড. আহমেদ এহসানুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। ড. সমীর কুমার সাহা বলেন, শুধু মৃত্যুহার নয়, কত সংখ্যক শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে সেই সংখ্যাটি জানাও গুরুত্বপূর্ণ। দেশে এখনো পর্যন্ত ৫০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার কারণ জানা যায় না। এই তথ্য ছাড়া ভবিষ্যতে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, বেড না থাকায় প্রতিবছর শিশু হাসপাতাল থেকে সাড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। ওইসব শিশুদের অধিকাংশই নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হবার জন্য আসে।

ড. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালের বিডিএইচএসের তথ্য অনুযায়ী দেশের মাত্র ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিউমোনিয়ার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সক্ষমতা আছে। ৫০ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর নেই। এক-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অক্সিজেনসহ অন্যান্য অনুসঙ্গও অনুপস্থিত। মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জেলা হাসপাতালে পালস অক্সিমিটার আছে। অভিভাবকদের মধ্যেও সন্তানকে চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবার প্রবণতা কম। মাত্র ৩৪ শতাংশ শিশু এন্টিবায়োটিক ওষুধ গ্রহণ করে।

ড. মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী হাসপাতালে পালস অক্সিমিটার, স্বল্পমূল্যের দেশীয় অক্সিজেন স্বল্পতা দূর করার বিষয়ে আলোচনা করেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন প্লাস্টিক বোতল দিয়ে তৈরি বাবল সিপ্যাপ নিউমোনিয়া জনিত শিশু মৃত্যুহার ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে সক্ষম। অপুষ্টির শিকার শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর প্রবণতা ১৫ গুন বেশি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App