×

সাময়িকী

কবি ও কথাসাহিত্যিক নুরুল করিম নাসিম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২০, ০৬:৩৭ পিএম

কবি ও কথাসাহিত্যিক নুরুল করিম নাসিম

সদ্যপ্রয়াত সাহিত্যিকবন্ধু নুরুল করিম নাসিমের ওপর আজ আমাকে স্মৃতিবাক্য লিখতে হবে- তা ভাবিনি এবং তিনি যে এত তাড়াতাড়ি বিদায় নেবেন তাও আঁচ করতে পারিনি। আমি যখন ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে আসি, সাহিত্যকে সঙ্গী করে এবং জীবিকার সন্ধানে, তখন যে-কজন সমবয়সী সাহিত্যিকবন্ধুকে পেয়েছিলাম সেদিন, নুরুল করিম নাসিমও তাদের মধ্যে অন্যতম। তখন সাহিত্যপাতায় লেখা ছাপানো এবং সাহিত্যিকমহলে পরিচিত হওয়ার বাসনা ছিল প্রবল। লিখতামও তখন প্রচুর। তার লেখাও প্রায়ই দেখতাম সাহিত্যপাতায়। সেই বন্ধু হঠাৎ দেশের বাইরে চলে যায় চাকরি নিয়ে। দীর্ঘ ফাঁক তৈরি হয় আমাদের সম্পর্কের। ক’বছর পর আবার ফিরে আসে দেশে। লেখালেখি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি তিনি।

জন্মগ্রহণ করেছেন ঢাকায় ২৫ মে ১৯৫১ সালে; মৃত্যুবরণ করেছেন গত ৫ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ৭০ বছর বয়সে ঢাকায়। শেষজীবনে নুরুল করিম নাসিম শরিয়তপুরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। আমার সঙ্গে বা অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতে তার আলোচনার বিষয় হতো সাহিত্য। খুচরো কত গল্প মানুষ করে, আমরাও করি- কিন্তু এই প্রাণখোলা মানুষটি ছিলেন সাহিত্যে নিবিষ্ট মানুষ। পঠনপাঠনও প্রচুর করতেন, লিখতেন সে তুলনায় কিছু কম। পরবর্তী সময়ে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করেছি- লেখা ছাপানোর জন্য বড় কোনো তাগিদ লক্ষ করিনি তার মধ্যে। বই প্রকাশের ব্যাপারে খুব তৎপর হননি কখনো। ২০১৮ সালের বইমেলায় তার ‘নির্বাচিত কবিতা’ প্রকাশিত হলো। একদিন আমাকে ফোন করে বললেন- কাল কি প্রোগ্রাম তোমার। বললাম- তেমন কোনো প্রোগ্রাম নেই। তখন বললেন- কাল তুমি আমার ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবে, বইমেলা প্রাঙ্গণে। যেন তার নির্দেশ! বললাম- আচ্ছা। পরদিন যথারীতি চলে গেলাম নির্দিষ্ট স্থানে। গিয়ে কোনো আয়োজন চোখে পড়লো না। ফোন করলাম- কী নাসিম, আমি তো হাজির তুমি কোথায়। নাসিম দশ মিনিটের মধ্যে মিষ্টির একটা প্যাকেট নিয়ে হাজির হলো। বললাম- এই ভালো। -তো মোড়ক উন্মোচনের আয়োজন করো। কী সরল মানুষ- বন্ধু আমার! আমার হাতে কাগজে-মোড়ানো বইটি তুলে দিয়ে বললো- নাও, উদ্বোধন করো! বই হাতে নিয়ে কিছু বলতেই কয়েকজন লোক জোগাড় করে ফেললেন। আমি তার কবিতা প্রসঙ্গে তখন বলেছিলাম- কবি নুরুল করিম নাসিমের কবিতা আমাদের যাপিত সময়ের রূপায়ণ। তিনি প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পড়াশুনা করেছেন, কিন্তু দেশীয় আবহের মধ্যেই তার কাব্যবিচরণ। তার কবিতায় আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-নিজস্ব আবেগ-দেশীয় আবহ- প্রকৃতিপ্রেম প্রতিভাত হয়েছে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোতে আমরা কবি নুরুল করিম নাসিমের নিজস্ব উচ্চারণ শুনতে পাই। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে- ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘ভগ্নাবশেষ’, ‘যে যার ভ‚মিকায়’, ‘যে শহরে এখন শেষ রাত’, ‘যে যায় সে যায়’, ‘বাইরের জানালা’, ‘তিন ভুবনের যাত্রী’, ‘বিজন বাড়ি নেই’, ‘গুড মর্নিং গুরুদেব’, ‘শিপুর দিনরাত্রি’, ‘সাক্ষাৎকার ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য’, ‘বিশ্বসাহিত্যে কথাশিল্পী তেরো’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আমার খুব মনে পড়ছে, বছর চারেক আগে আমি আর নাসিম নীলফামারীর ডোমারে এক সাহিত্যসভায় আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বাসে যেতে যেতে পুরোটা রাস্তায় আমাদের দুজনের আলোচনার বেশি সময় দখল করে নিয়েছিল সাহিত্য। এমনকি সেইরাতে ঘুম শিকেয় তুলে আমরা নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলাম অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সাথে সাহিত্যআড্ডায়। এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আমাদের! তখন এক নতুন নাসিমকে আমি চিনেছিলাম, যে নাসিম সাহিত্য-অন্তঃপ্রাণ। মাঝে মাঝে ঢাকা ক্লাবে সাহিত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন নুরুল করিম নাসিম। তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন প্রয়াত মীজানুর রহমান শেলী। পরিপাটি সে আয়োজনে আমিও কয়েকবার অংশগ্রহণ করেছি। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, ছিলেন সাহিত্যের সার্বক্ষণিক সাধক। সাহিত্যিক নুরুল করিম নাসিমকে কখনো প্রাপ্তির মোহে আচ্ছন্ন হতে দেখিনি। কখনো পুরস্কারের পেছনে ছুটেছে বলে শুনিনি। এমনকি কোনো প্রকার দলাদলিতেও থাকেননি তিনি। এই নির্মোহ সাহিত্যসাধকের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। বিদায় হে বন্ধু আমার!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App