×

জাতীয়

দেশে আর কোনো স্বৈরশাসকের যেন জন্ম না হয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪৫ এএম

দেশে আর কোনো স্বৈরশাসকের যেন জন্ম না হয়

মরিয়ম বিবি, শহীদ নূর হোসেনের মা

রোদে পোড়া তামাটে শরীরটা ছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ইশতেহার। বুকে-পিঠে লেখা মাত্র দুটি দফায় স্পষ্ট করেছিলেন স্বৈরশাসকের বন্দুকের নল থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির দাবি। রক্তের অক্ষরে লিখেছিলেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। উদোম শরীরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ স্লোগানে উজ্জ্বল এক জীবন্ত পোস্টার বাংলা মায়ের সন্তান শহীদ নূর হোসেন। আধুনিক বাংলার অন্যতম কবি শামসুর রাহমান ‘আলো ঝরানো ডানা’ কবিতায় যাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সিসা, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে।’ স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেন নূর হোসেন। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে শহীদ সন্তানের জন্য ৩৩ বছর ধরে চোখের জল ফেলছেন ৮০ বছর বয়সি মা মরিয়ম বিবি। তবে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া ছেলের জন্য তার গর্বও কম নয়। ছেলের রক্তের ধারা বেয়ে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, মুক্তি পেয়েছে কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান তার। বললেন, দেশে যেন আর স্বৈরশাসকের জন্ম না হয়। আমার মতো আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। এটুকুই আমার চাওয়া।

নব্বইয়ের দিকে দীপালি সাহা, কাঞ্চন, দেলোয়ার, মনু মিয়া, সেলিম, বসুনিয়া, ডা. মিলন, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, নূর হোসেনের রক্তের প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের ক্ষমতার গদি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর, বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ সেøাগান লিখে রাজপথের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ কর্মী ২২ বছরের যুবক নূর হোসেন। শহীদ নূর হোসেন দিবসকে সামনে রেখে গতকাল সোমবার টেলিফোনে ভোরের কাগজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মা মরিয়ম বিবির এই চাওয়ার কথা জানান শহীদ নূর হোসেনের ছোট ভাই আলী হোসেন।

রাজধানীর ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে একটি বাস কাউন্টারে টিকেট বিক্রির কাজ করতেন নূর হোসেন। সংসার চালানোর জন্য ওই টাকার পুরোটাই তুলে দিতেন বাবার হাতে। রাতে পড়াশোনা করতেন। এসএসসি পাসও করেছিলেন তিনি। কিন্তু আর এগুতে পারেননি। এর আগেই পুলিশের গুলিতে রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়েন আজীবন সংগ্রামী এই তরুণ। মূলত নূর হোসেন শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান হয়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সব মূল বিরোধী দল ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বর্জন করে। এভাবে সুসংহত আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর সরকারের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডাবাহিনীর গুলিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় চত্বরে নিহত হন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. শাসমুল আলম খান মিলন। ৬ ডিসেম্বর পতন হয় স্বৈরাচার এরশাদের। নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। কিন্তু যাদের রক্তের বিনিময়ে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু, ক্ষমতায় এসে তাদের কথা বেমামুল ভুলে যায় দলটি। আলী হোসেন বলেন, ’৯১-এ ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ হারানো সব শহীদ পরিবারকে ভুলে যায় বিএনপি। একদিনের জন্যও তারা আমাদের খোঁজ নেয়নি। আজ নূর হোসেন দিবসে ঘটা করে তারা ফুল দেয়, শ্রদ্ধা জানায়, গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে; কিন্তু যাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে, তাদের পরিবারের কোনো খোঁজ নেয় না।

ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার গাড়িচালক ছিলেন আলী হোসেন। এখন বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানা, রেহানাপুত্র ববি ও শেখ হাসিনার কন্যা পুতুলের গাড়িও চালান তিনি। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আলী হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীই আমাদের পরিবারের অভিভাবক। তিনি প্রতি মাসে আমাকে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা দেন। গত ঈদে আমার মাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। আমার মেয়েকে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়িয়ে এখন ব্যাংকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমার বড় ছেলেকে বিশ^বিদ্যালয়ে এবং ছোট ছেলেকে নৌবাহিনীর কলেজে পড়ার দায়িত্বও নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু আমাদেরই নয় অন্যান্য শহীদ পরিবারেরও অভিভাবক বঙ্গবন্ধুকন্যা।

নূর হোসেনসহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সব শহীদদের একদিন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানোর দাবি আলী হোসেনের। বললেন, দীপালি, কাঞ্চন, দেলোয়ার, মনু মিয়া, সেলিম, বসুনিয়া, ডা. মিলন, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, নূর হোসেনরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। তাদের পরিবার, অনেকের সন্তান-সন্ততিকে দেশের মানুষ চেনে না। এদের সবাইকে যদি একদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হয় তাহলে দেশের সুনাম বাড়বে। অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম আরো জাগ্রত হবে। তারা দেশের জন্য আরো অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।

নূর হোসেনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমার ভাই শুধু পরিবার আর রাজনীতির জন্যই কাজ করত না। সমাজসেবাও ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। ড্রেনে কুড়িয়ে পাওয়া সদ্যজাত শিশুকে উদ্ধার করে এক দম্পতিকে দিয়েছে। ময়না নামের সেই শিশুটি আজ বিয়ে করে সংসারী। এছাড়া আমাদের বনগ্রামে একটি মাত্র নলকূপ থেকে সবাই খাবার পানি সংগ্রহ করত। মানুষের কষ্ট লাঘবে সে ভোরবেলায় বালতি করে পানি মানুষের বাড়িতে দিয়ে আসত। নিজ উদ্যোগে স্যুয়ারেজ লাইন ঠিক করে দিত।

বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ধারা এগিয়ে চলছে মন্তব্য করে আলী হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা এ জন্য দেশের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তবে এ জন্য সময় প্রয়োজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App