×

মুক্তচিন্তা

ডিজিটাল দুনিয়ায় স্বস্তি ও শঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২০, ১০:৫৬ পিএম

আপনার ল্যাপটপ তো আপনার অতি প্রিয়। একরকম সব সময়ের সঙ্গী। সঙ্গে সঙ্গেই চলে বাসা থেকে অফিসে, অফিস থেকে বাসায়। মাঝখানে আসা-যাওয়ার পথে ঘুমিয়ে থাকে সে। অফিস থেকে আপনি বাসায় এলেন রাস্তার গ্লানি মুছতে হাত-মুখ ধুতে গেলেন বাথরুমে। মা বা স্ত্রী ডাকছেন, গরম গরম শিঙাড়া আর কফি অপেক্ষা করছে। শুইয়ে দিলেন ল্যাপটপটাকে। শাটডাউন করেই রাখলেন। তবুও স্বভাবগতভাবেই কভারটা খোলাই পড়ে থাকল। বিকালের খাবারটা পরিবার নিয়ে ভালোই উপভোগ করলেন। পারিবারিক কিছু সমস্যার কথাও আলোচিত হলো টেবিলে। তারপর একসময় ল্যাপটপটি হাতে করেই বেডরুমের বিছানায় গা’টা এলিয়ে দিলেন। বন্ধ ঘরে আপনি আছেন আপনার প্রাইভেসি নিয়ে। কেউ নেই সেখানে। বাইরে থেকেও কেউ দেখছে না। আপনার পৃথিবীতে আপনি একা। আপনার ব্যক্তিগত সময় আপনাকেই উপহার দিচ্ছে এমনটা তো আপনি ভাবতেই পারেন। কিন্তু আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে তা হয়ে গেছে একেবারেই বিগত ইতিহাসের অংশ। বর্তমানটা উল্টো দিকে চলছে। আপনার ল্যাপটপটি অবশ্যই শাটডাউন হয়ে আছে। কিন্তু খোলা ছিল শুধু টপ কভারটা। তাতেই হলো যত ঝামেলা। আপনি আর একা থাকতে পারলেন কোথায়? আপনার ল্যাপটপের মনিটর প্যানেলের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটি লেন্স আছে। আপনি বুঝতে পারছেন না যে, এই লেন্সটা ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। ল্যাপটপটির কানেকশনও নেই। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। লেন্সটা খোলা থাকলেই যথেষ্ট। ক্যামেরা চলছে, অনবরত চলছে। কেউ না কেউ ও-মাথা থেকে দেখছে আপনার ঘর, আপনাকে, আপনার পরিবারকে। রাতে শুয়ে শুয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করছেন। বউয়ের পরামর্শ চাচ্ছেন কীভাবে একটা ফ্ল্যাট নিজে ক্রয় করা যায়। কোন এলাকায় কিনলে ভালো হয়, কোথায় কত দাম চলছে, লোন নিতে কী কী ঝামেলা পোহাতে হয় ইত্যাদি অনেক বিষয়েরই জরুরি আলোচনা চলছে। মোবাইল ফোনটা পাশেই আছে। ইন্টারনেট, জিপিএস সব বন্ধ আছে। গল্প-আলোচনা শেষ করে ফোনের নেট অন করলেন, ফেসবুকে প্রবেশ করলেন। অবাক হয়ে লক্ষ করবেন, ২-৩টি পোস্টের পরই আসবে একটি বিজ্ঞাপন ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন। কয়েকটি পোস্টের পর আবারো আসবে ওই ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন। আপনি যা যা আলোচনা করেছিলেন, তার সঙ্গে সমন্বয় রেখে এমন ধরনের বিজ্ঞাপন আপনাকে অবাক করলেও আজকের দিনের বিজ্ঞানকে মোটেও অবাক করছে না। আপনার ফোন বন্ধ ছিল ঠিকই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আপনার ফোনের মাইক্রোফোন চলছে অনবরত চলছে। কেউ না কেউ শুনছে বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে। শুধু শুনছেই না, আবার দেখছেও ফোনের ক্যামেরা দিয়ে দেখছে। অতি গোপনীয় রাজনৈতিক নির্দেশনা জারি করছেন। সরকারের বড় চেয়ারে বসে গোপনে দেখা করছেন কেউ। বড় বড় চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করছেন। সবই আপনার অথবা অন্য কারো ফোনের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভিন দেশে। তারা গোপনীয়তা বজায় রাখছে বলে অন্য কেউ হয়তো জানতে পারছে না। তবে তারা চাইলেই মুখ খুলতে পারে, তারা চাইলেই ছবিগুলো ফাঁস করে দিতে পারে। ফেসবুক এমনটা করেনি এখনো। তবে তাদের কাছে সব রেকর্ডই আছে। একবার ভেবে দেখুন, কেমন শক্তিধর ফেসবুকের আবিষ্কারক মার্ক জোকারবার্গ। সাধারণ বাজারে চাল-ডাল, ফোন, বাড়ি, গাড়ি সবই পণ্য। আর টেকনোলজি বিশ্বে আমরা মানুষরা ফেসবুকের পণ্য। আমরা কিছু বুঝার আগেই ফেসবুকের পণ্য হয়ে বসে আছি। কোন অ্যাপ ইনস্টল করতে চান? প্রথমেই অ্যাপটি প্রশ্ন করবে আমরা কি আপনার ফোনের ক্যামেরা, কনটাক্ট, মেসেজ ইত্যাদি ইউজ করতে পারি? আপনি সম্মতি দিলে ওই অ্যাপ চালু হবে, আর সম্মতি না দিলে অ্যাপটি পাবেন না। আপনি সম্মতি দিয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই অ্যাপটি প্রবেশ করবে আপনার ব্যক্তিগত জগতে। অ্যাপটি বুঝার চেষ্টা করবে আপনার চাহিদাটা ঠিক কী? এটাই আজকের বাজার অর্থনীতির ভিত। রাস্তায় দাঁড়িয়ে, অফিসে অফিসে ঘুরে সমীক্ষা চালানোর দিন এখন শেষ। আজ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগ। ফেসবুকে লাইক দিলেন যা ভালো লাগল। অথবা একটু থমকে দাঁড়িয়ে দেখে নিলেন যাতে আপনি আকৃষ্ট হলেন। আপনি কিন্তু জানতেও পারলেন না, কেউ আপনার ওই লাইকের কথা জেনে গেল। কতটা সময় আপনি সেই পোস্টের জন্য ব্যয় করছেন তা-ও বুঝে নিল কেউ একজন। এরপর থেকে সেই ধরনের পোস্টই কিন্তু আপনার কাছে বেশি বেশি আসতে থাকবে। ধীরে ধীরে আপনাকে এদিকেই আসক্ত করে তুলবে। বিজ্ঞাপনের হাতে বন্দি হয়ে যাবেন আপনি। বিজ্ঞাপনদাতারা তা-ই খুঁজছে আপনার লাইক খুঁজছে। আর আপনি নিজের অজান্তেই প্রবেশ করছেন নতুন এক বিজ্ঞাপন দুনিয়ায়। কারো নজরে আপনি ঠিক আছেন। কোনো ব্যক্তি নয়, আপনাকে নিয়ে খেলছে সার্ভার-কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। আপনার যত ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশ, সবই স্টোর হয়ে যাচ্ছে কোনো এক জায়গায়। সার্ভারের একটি কোণে আপনার দুনিয়া ইনস্টল হয়ে যাচ্ছে। আপনি হয়ে যাচ্ছেন সেখানে আপনারা অঙ্কের সূচকের মাধ্যমে একই অনুভ‚তির মানুষের সঙ্গে কানেক্টেড। আপনাদের আসক্তিকে বিক্রি করছে কেউ। সেখানেই তাদের উপার্জনের পথ। বিজ্ঞাপনদাতারা তা কিনে নিচ্ছে প্রচুর দাম দিয়ে। আমরা বিক্রি হচ্ছি, আমাদের ডেটা বিক্রি হচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রামকে অর্থ দিচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতারা। আমরা তার পণ্য। তারা চাইছে নিশ্চয়তা, আমাদের ডেটা। যা আছে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টিকটক সবার কাছে মূল্য তথ্যই আজকের দুনিয়ায় উপার্জনের পণ্য। যার কাছে যত বেশি ডেটা বা তথ্য, সে তত বেশি ধনী। ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু একেবারে শেষভাগে এসে সমীকরণ বদলে গিয়েছিল। রিপাবলিক দলের প্রার্থী ট্রাম্প সুইং স্টেটগুলোর ভোটের ওপর নির্ভর করে বাজিমাত করেছিলেন। এর সঙ্গে ধীরে ধীরে বাজারে এলো একটি নাম ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার অফিস। এখান থেকেই ট্রাম্পের প্রচারের জন্য দিনে ফেসবুক-বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ হতো ১০ লাখ মার্কিন ডলার। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার হয়ে যিনি পুরো বিষয়টিকে রূপ দিয়েছিলেন, তার নাম ব্রিটনি কাইজার। ফেসবুক তাকে বা তার কোম্পানিকে দিয়েছিল ৩ কোটি মার্কিন নাগরিকের তথ্য। ইনফো গ্রæপ দিয়েছিল ৬ কোটি ই-মেইল। এই তথ্য কাজে লাগিয়েছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। প্রথমে তারা প্রোফাইল খতিয়ে দেখে। খুঁজে নেয় কোন ভোটারের কী দুর্বলতা? ঠিক সেভাবেই মেসেজ, ভিডিও তৈরি করে পাঠিয়ে দিয়েছিল তাদের অ্যাকাউন্টে। ভোটার তা দেখেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন। ফলটা পাওয়া গিয়েছিল ভোটের দিনে। একই ঘটনা ঘটেছিল ব্রিটেনেও। ব্রেক্সিট-ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রচার প্রক্রিয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ব্রিটনি কাইজার। ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোতে সরকার পরিবর্তনের নেপথ্যেও ছিল এই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার প্রোপাগান্ডা। যুব সম্প্রদায়কে হাত করে ফেলল। মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত ভোট দেব না। এই মাস্টার প্ল্যানই কাজ করে ফেলল। একটা অংশ ভোট দিল না। ক্ষমতাও বদলে গেল। কিন্তু একসময় ব্রিটনি ফাঁস করে দিলেন সবকিছু। কাঠগড়ায় দাঁড়াল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। মার্কিন কংগ্রেসে জবাবদিহি করতে হলো মার্ক জোকারবার্গকে। ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করার অভিযোগ উঠল তাদের বিরুদ্ধে। মানুষের জীবনে ডিজিটাল টেকনোলজি অনেক বড় কিছু নিয়ে এসেছে এমনটাই প্রমাণ করেছে ফেসবুক, গুগল, টিকটক, ইউটিউব এসব সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু এর সঙ্গে কি তারা অভিশাপও নিয়ে এসেছে? নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে নিজে থাকাটাই বেঁচে থাকা। আমি-র শুরু ও শেষ আমি-তেই। আমার যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, তা-ই বিশ্বাস করি। যা বিশ্বাস করি, তাকেই বাস্তব বলে জানি। যাকে বাস্তব বলে জানি, অন্যদেরও তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করি। বারবার বলতে থাকি এক কথা, যাতে কথাটা ঘুরে ঘুরে দাঁড়িয়ে যায় নিজের পায়ের জোরে। আর এটাই করে যায় সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়ার জালে আটকে গিয়েছি আমি-র আমরা। শত চেষ্টাতেও মানুষ আজ পারবে না ডিজিটাল দুনিয়ার জাল কেটে বাইরে থাকতে। এখানেই ডিজিটাল টেকনোলজির সাফল্য এখানেই ডিজিটাল দুনিয়ার বিষফল। লোকে যত ফেসবুক-টুইটার-ইনস্ট্রাগ্রাম-টিকটক-গুগল ইত্যাদি ব্যবহার করছে, ততই সমাজে আলো না বেড়ে কালো বাড়ছে, মেরুকরণ বাড়ছে; হিংসা-মারামারি বাড়ছে, ধর্ষণ-নিধন-বিষ সবই বাড়ছে। হিউম্যান ব্রেনের মধ্যে যে একটি বিভাজিত হয়ে যাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা আছে, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম সম্ভবত আমাদের মাথায় ঠিক সেই জায়গাটিতেই প্রথম ডাক পাঠায় ভাগ হয়ে যাও, ভাগ হয়ে যাও। ‘সোশ্যাল ডিলেমা’ তথ্যচিত্রটির নির্মাতা জেফ অরলোস্কি কয়েকদিন পূর্বে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন ‘উই নিড টু রিথিংক সোশ্যাল মিডিয়া বিফোর ইটস টু লেট’ নামে। ভাবতে ভুলিয়ে দেয়া ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি আমাদের বাঁধনহীন প্রেম বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভয় পাচ্ছি একেবারেই তা যেন প্রেমের দাসত্বে পরিণত না হয়ে যায় একদিন। মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App