×

মুক্তচিন্তা

গণতন্ত্রের বিজয়ে আমেরিকা মানবিক হোক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২০, ১১:০১ পিএম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে অভিনন্দন। বাইডেন নির্বাচিত হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে আমরা মনে করছি। আর আন্তর্জাতিকভাবে ভাবমূর্তিগত পরিবর্তন তো আসবেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই সমগ্র আমেরিকাকে সারাক্ষণ যেন এক পোস্টমর্টেম টেবিলের ওপর শুইয়ে রেখেছিলেন! তাই সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল আমেরিকাকে এক প্রকার মুক্তি দিয়েছে বলা যায়। এই মুক্তির অগ্রদূত জো বাইডেন। ঐক্যবদ্ধ ও মানবিক এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠনে বাইডেনের আগ্রহ আমাদের আশাবাদী করে। তাই তাকে অভিনন্দন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে ও পরে অগণতান্ত্রিক নানা রকমের বক্তব্যে তিনি তার সমর্থকদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন। সমর্থকরা বিভিন্ন ভোট গণনা কেন্দ্রে বিক্ষোভ করছে। তিনি নিজেও একাধিক ভোট গণনা কেন্দ্রের ভোট না গণনার জন্য মামলা করেছেন। তার একাধিক মামলা খারিজও হয়ে গেছে। চারদিক থেকে বিজয়ী বাইডেনকে অভিনন্দিত করা হলেও ট্রাম্প এখনো তার মুখ খোলেননি। সব মিলিয়ে ২০২০ সালের আমেরিকার নির্বাচন ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। আমাদের জানা নিকটতম ইতিহাসে আমেরিকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরূপ বিতর্ক এবং অগণতান্ত্রিক রীতি-নীতির চর্চা কখনো হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণার পূর্ব থেকে নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়া এমনকি ভোট গণনাকালেও ট্রাম্প যেসব কথাবার্তা বলছেন, তার সমর্থকরা যেসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে তাতে বিশৃঙ্খল পরিবেশই সৃষ্টি হয়েছে। গণরায় মেনে নেয়ার মানসিকতা থেকে ট্রাম্প নিজেকে রহস্যজনক কারণে সরিয়ে রেখেছেন। ৯ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ডেমোক্র্যাটদের ‘ভোট চোর’ বলে অভিহিত করছেন। ভোট চুরির অভিযোগে তিনি পুনরায় মামলাও করছেন! তবে সমালোচকরা মনে করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নামে ফৌজদারিসহ বিভিন্ন অপরাধে প্রায় অর্ধ ডজন শাস্তিযোগ্য মামলা আছে। হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে গেলে তার নামে মামলাগুলো পুনরায় সক্রিয় হতে পারে। তাই নানা টালবাহানায় ট্রাম্প চাইছেন নির্বাচনকে পণ্ড করতে! কিন্তু মার্কিনিরা তো বটেই গণতন্ত্রকামী বিশ্বনাগরিকরা ট্রাম্পের এই মনোভাবকে পছন্দ করছে না। উপরন্তু নতুন আমেরিকা গড়ার বাইডেনের প্রত্যয়কে বহু মার্কিনির মতো অনেক বিশ্বনেতাও সমর্থন জানিয়েছেন। নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বহুমাত্রিক কাজের আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার সময় থেকে শুরু করে ২০২০ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় গ্রহণের সময়ও ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে আলোচনায় রাখছেন। কিন্তু এটি যে অশোভন একটি ‘কৌশল’ তা নিয়ে তিনি মোটেই মাথা ঘামান না। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে যে, তার পরিবারের অনেক সদস্য ইতোমধ্যেই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তিনি কারো কথা শুনতে রাজি নন। আমরা জানি না, তার এই একগুঁয়ে এবং অগণতান্ত্রিক জেদের শেষ কোথায়! সুপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘সবক’ দেয়ার ওস্তাদও এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন দেখলাম। দেখলাম ভোট গণনা নিয়ে অগণতান্ত্রিক উত্তেজনার চিত্রও। যা উন্নত রাষ্ট্রের বিশেষত টেকসই ও সুপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মোটেই শোভন নয়। ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার জনগণ এবং সমগ্র বিশ্ববাসী যে অগণতান্ত্রিক আচরণ দেখল তা আগে কখনো দেখেনি। নির্বাচনের আগে থেকেই ক্ষমতাসীন ট্রাম্প সরকার ও তার সমর্থকদের আচরণ গণতন্ত্রকামী বিশ্ববাসীকে দুর্ভাবনার মধ্যে ফেলেছে। এ দুর্ভাবনা অমূলক নয়; বরং ব্যাপক এক দুশ্চিন্তার ক্ষেত্রও প্রস্তুত করে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবারকার নির্বাচন উন্নয়নশীল দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র চর্চায় একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিতেই পারে। সে আশঙ্কা একেবারেই কি উড়িয়ে দেয়া সম্ভব? আমাদের তা মনে হয় না। নির্বাচনের পূর্ব থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আমরা দেখেছি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতিকে উপেক্ষাপূর্বক বক্তব্য-ভাষণ দিতে। শুধু উপেক্ষা বললেও ঠিক হবে না যাকে বলে একেবারে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য, অবহেলা এবং অপমান করেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি, যা কিছুটা আবার অমানবিকতার দোষেও ছিল দুষ্ট! একটি মডেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি গণতন্ত্রের গালে ক্রমাগত চপেটাঘাতই করেছেন! বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার বক্তব্য-ভাষণে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে গণতন্ত্রকে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি হাস্যকর করেছেন। গর্বিত আমেরিকাবাসী কিংবা গণতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী রিপাবলিকানদের নিকট থেকে এমন আচরণ কেউ প্রত্যাশা করেনি। ইতোপূর্বে আমেরিকার কোনো নির্বাচনে এমন ঘটনা ঘটেনি। ফলে গত কয়েকটি দিন গণতন্ত্র নিয়ে চরম এক হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত ছিল সমগ্র বিশ্ববাসী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা গণতন্ত্রেরই বিজয় দেখলাম। নির্বাচনোত্তর ট্রাম্পের উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং তার সমর্থক গোষ্ঠী কর্তৃক বিভিন্ন কেন্দ্রের ভোট গণনা বন্ধ রাখার দাবিতে বিক্ষোভও আমাদের হতাশ করেছে। আমরা হতাশ হয়েছি পরাজয়ের আশঙ্কায় ‘ফলাফল’ নির্ধারণী কেন্দ্রসমূহের ভোট গণনা বন্ধ রাখার ট্রাম্পের মামলা করার ঘটনায়। নির্বাচনে সহিংসতা বা অন্যান্য বহুবিধ কারণে প্রার্থী আইনি সাহায্যের দ্বারস্থ হতেই পারেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ‘অজুহাতে’ আইনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তা নিতান্তই হাস্যকর! গণতন্ত্র চর্চার সূতিকাগার হিসেবে যে রাষ্ট্রটি সমগ্র বিশ্বে প্রায় এককভাবে ‘মোড়লগিরি’ করে আসছে সে দেশের একটি সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বিশ্বের সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। রিপাবলিকান দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষ থেকে গৃহীত নির্বাচনোত্তর অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রভাব আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে কীভাবে প্রতিফলিত হবে সে সম্পর্কেও স্বাভাবিক এক শঙ্কা জাগে। আবার কখনো কখনো এও মনে হয় যে, তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক শিক্ষাই কি ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করলেন! গ্রহণ করলেন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের মারদাঙ্গার স্বভাবটিও! এসব মনে হলে হতশ্বাসের বিস্ময় বোধও জেগে ওঠে মনে! পাশাপাশি, চিন্তাশীল ও গণতন্ত্রকামী বিদগ্ধ মহলের মুখে দুঃখমিশ্রিত এক ধরনের করুণ হাসির রেখাও ফুটে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ হাসি হতাশার, শ্লেষেরও! তাদের এ হাসি স্ব-স্ব রাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনায় ক্লিষ্ট, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বেদনামিশ্রিত আশঙ্কার! এরূপ হাসির অন্তরালে লুকিয়ে থাকে নিজ নিজ দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের কল্পিত অবয়বের শঙ্কিত মূর্তি দর্শনের হতশ্বাস! ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে কোনো দেশের মজবুত গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা ও বিকাশের অন্তরায়। আর এ ঘটনাটি যখন উন্নত কোনো রাষ্ট্রে দেখা যায় তখন অনুন্নত বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা মনে মনে খুশিই হয়! কিন্তু এরূপ ঘটনা যে কোনো রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ও গণতন্ত্রের জন্য খুবই বিপজ্জনক। ব্যক্তিগত চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেনকে বেশি সংযত মনে হয়। অর্ধ শতবর্ষের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় তিনি নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন বলেই বাইডেনকে ট্রাম্পের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসীও মনে হয়েছে। পক্ষান্তরে ট্রাম্পকে মনে হয়েছে হঠকারী এবং অগণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে। বিগত শাসন মেয়াদে ট্রাম্পের চারিত্র্যিক এই গুণাবলির সঙ্গে বিশ্ববাসী সম্যক পরিচিত হয়েছেন। ভোট গণনাকালে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হলে আত্মবিশ্বাসী এক ভাষণে বাইডেন বলেছিলেন, ‘৭৪ মিলিয়ন মানুষ তাকে এবং তার রানিং মেট কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দিয়ে করোনা ভাইরাস, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্ণবাদ মোকাবিলার ম্যান্ডেট দিয়েছেন।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মার্কিনিদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন বিভক্তি পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য। একই সঙ্গে তিনি তাদের ধৈর্য ধারণ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা রাখার আহ্বানও জানিয়েছেন। বাইডেন আরো বলেছিলেন, ‘ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের শান্ত থাকা প্রয়োজন।’ আত্মবিশ্বাসী ভাষণে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘একবিংশ শতাব্দী আমাদের না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের শুধু মনে রাখতে হবে আমরা কারা।’ আর পরে ফলাফল ঘোষণা শেষে বিজয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাইডেন বলেছেন, ‘নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এখন সময় রাগ, ক্ষোভ, প্রতিক্রিয়া পেছনে ফেলে এক জাতি হিসেবে কাজ করার। এখন সময় আমেরিকার ঐক্যের ও বিজয়ের। বিশ্বের সেরা এ দেশটির নেতৃত্ব দেয়া কঠিন কাজ। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, আমি সব মার্কিনির জন্যই প্রেসিডেন্ট। যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন আর যারা দেননি, সবার জন্যই।’ বাইডেনের সব পর্যায়ের বক্তব্য সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে আমাদের মনে আশার সঞ্চার ঘটায়। আমরা তো শেষ পর্যন্ত আশা নিয়েই বাঁচি। যুগে যুগে দেখা গেছে শত প্রতিক‚লতার বিপরীতে বুকভরা আশা নিয়ে কেউ না কেউ এসে দাঁড়ান, হাল ধরেন। জো বাইডেন হঠকারী মেজাজের ট্রাম্পের বিপরীতে সেই প্রত্যাশা পূরণের প্রতিশ্রæতি নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাল ধরবেন বলে আমরা আশা করছি। মানবিক এক আমেরিকা দেখার প্রত্যাশা আমরাও করি। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App