×

সারাদেশ

হাজার কোটি টাকার হাতছানি আগর-আতর রপ্তানিতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২০, ১২:০৩ পিএম

হাজার কোটি টাকার হাতছানি আগর-আতর রপ্তানিতে

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত আগর কাঠের বাগান -ভোরের কাগজ।

প্রায় ৩০০ বছর ধরে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় এক হাজারের বেশি পরিবার ধরে রেখেছেন আগর-আতরের ব্যবসা। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আরো প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। বিপুল সম্ভাবনাময় শিল্প হলেও এখানে গড়ে ওঠেনি আগর-আতর থেকে সুগন্ধি তৈরির কোনো কারখানা। পাশাপাশি জ্বালানি গ্যাসের সংকট, মূলধন সমস্যা ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও এ শিল্পের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। দেশের বাইরে বিপণন কার্যক্রম ও অনাপত্তি সনদ প্রাপ্তিতেও আছে দীর্ঘসূত্রতা। এ শিল্পের উন্নয়নে মৌলভীবাজারে আগর-আতর শিল্পপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে এ শিল্পের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বন বিভাগের তথ্যমতে, বড়লেখায় নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ১৭৬টি হলেও এর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। জানা গেছে বিশ্ববাজারেও দিন দিন চাহিদা বাড়ছে এ শিল্পের। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে আগর-আতর রপ্তানি হয়। এসব দেশে বাংলাদেশিদের একাধিক আগর-আতর কারখানা আছে। এসব কারখানার কাঁচামাল যায় মৌলভীবাজার থেকে। বড়লেখাতেই বছরে হাজার লিটারের বেশি আগরের নির্যাস তৈরি হয়। বিপুল চাহিদা থাকায় আগে সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হতো, এখন সেখানে কোনো পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না।

তবে করোনার প্রভাবে স্থবিরতা নেমে এসেছে ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি শিল্পে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না হওয়ায় বড় কারাখানাগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন করে গাছ ক্রয়ও সম্ভব হচ্ছে না। সবমিলিয়ে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা এখন মহাবিপাকে।

এ ব্যাপারে বড়লেখার আমেনা এন্ড ফাতেমা আগর উড এন্ড পারফিউমের পরিচালক আদিব মজিদ জানান, আগর-আতর ব্যবসা মূলত মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে। করোনাকালে বিমানের ফ্লাইট বন্ধ। কোনো পণ্যই পাঠানো যায়নি। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা বলা যাচ্ছে না। প্রায় ৮-১০ লাখ টাকার মাল অবিক্রীত আছে। আগে যেখানে কারখানায় ১০-১২ জন কাজ করত, সেখানে এখন ৪-৫ জন কাজ করে। অনেকে কাজ ছেড়ে গিয়ে অন্য পেশায় জড়িত হচ্ছে। তিনি জানান, বড় ব্যবসায়ীরা আরো বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাদের অনেকের কোটি টাকার উপরে আগর-আতর অবিক্রীত আছে।

এ ব্যাপারে আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের সহসভাপতি বকুল আহমদ ভোরের কাগজকে জানান, ব্যাংক লোন নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন তারা চরম বিপাকে। তিনি জানান, নিজের প্রতিষ্ঠানে বছরে ৫০-৬০ লাখ টাকা আয় হতো। এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে।

বড়লেখার গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব লিটন শরিফ জানান, বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নে আগর-আতরের সবচেয়ে বেশি কারখানা আছে। এখান থেকে উৎপাদিত শত কোটি টাকার আতর প্রতি বছর পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

বাংলাদেশ আগর এন্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশনের নেতারা জানান, ২০১৯ সালে বৈধ ও লাগেজ পথে জেলা থেকে সাত হাজার লিটার আতর বিদেশে পাঠানো হয়েছে। প্রতি লিটারের গড় দাম ছয় লাখ টাকা হিসেবে যার বাজারমূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে আগর কাঠ রপ্তানি হয়েছে আরো প্রায় ১৫-২০ হাজার কেজি। যার বাজারমূল্য প্রায় ২-৩ শত কোটি টাকা। এতে বছরে এ শিল্প থেকে ৭০০-৮০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সরকার এটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে বিপুল রাজস্ব উপার্জন সম্ভব।

জানা গেছে, সারাবছর কমবেশি আগর-আতর তৈরির কাজ হলেও মূলত জানুয়ারি থেকে শুরু হয় রপ্তানির মৌসুম। কিন্তু চলতি বছর করোনায় মার্চের পর থেকে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বন্ধ হয় আগর-আতর রপ্তানি। আটকা পড়ে ২০০-৩০০ কোটি টাকার আগর-আতর ও আতর কাঠ।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বারসের নেতা ইসহাকুল হোসেন সুইট জানান, এ শিল্পে সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি সমস্যাও অনেক। তিনি জানান, এ অঞ্চলে আগের শিল্প সংশ্লিষ্টদের সবচেয়ে বড় সমস্যা গ্যাস সংযোগ নিয়ে। কাঠ পুড়িয়ে ও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে উৎপাদন করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে। মূলধনের অভাব ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় আতর উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা।

এছাড়া আগর রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো সাইটিস (কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড অব ওয়াইল্ড ফনা এন্ড ফ্লোরা) ও এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট ) সনদ পাওয়া। এসব শর্তের জালে আটকা পড়েন অনেক ব্যবসায়ী ।

এ ব্যাপারে ঢাকার ব্যবসায়ী জিয়া হায়দার মিঠু জানান, বড়লেখার আগর আতরের কাঁচামালকে সামনে রেখে তিনি মৌলভীবাজার বিসিক শিল্প নগরীতে অত্যাধুনিক আগর আতরের কারখানা করেছেন। দেশের সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে ধরে রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য।

এ ব্যাপারে বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম আল ইমরান বলেন, করোনার কারণে আগর-আতর ব্যবসায়ীদের সমস্যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি জানতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি টিম এলাকা পরিদর্শন করেছে।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, রপ্তানিযোগ্য পণ্যকে সরকার সবসময় অধিক গুরুত্ব দেয়। আগর-আতর অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের সমস্য সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App