×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক জনশক্তি বনাম অপশক্তি হয়ে ওঠা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২০, ১১:২৬ পিএম

একটি দেশের জনগণ সেই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ যদি উৎপাদন, উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক, রাষ্ট্র রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সৃজনশীলতা অর্জন করতে পারে। আবার এসব অর্জন যদি সেই সমাজে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে না ঘটার বাস্তবতা বিরাজ করে তাহলে বিপরীতটিই ঘটতে বাধ্য। এটি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে রাষ্ট্র তার জনগণকে কতটা দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম তার ওপর। আধুনিক উন্নত দুনিয়ায় রাষ্ট্র তার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, নিয়মনীতি ইত্যাদিতে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এর ফলে উন্নত দেশগুলোতে বেশিরভাগ মানুষই রাষ্ট্রের জন্য জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, ব্যতিক্রমের সংখ্যা খুব কমই থাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের মতো দেশের। জনসংখ্যার ঘনত্ব যেখানে খুবই বেশি সেখানে সবাইকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা খুবই কঠিন কাজ। প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা দেয়ার মতো অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক দেশেরই থাকে না। সে কারণে জনগণকে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে একদিকে অশিক্ষা, বেকারত্ব, জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় চাহিদা ইত্যাদি পূরণ না হওয়ায় অনেকেই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে জনশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার অবস্থানে থাকে না। এদের অশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধত্বের প্রভাব, ধর্মান্ধতা, উগ্র হঠকারিতা দ্রæত গ্রাস করে নেয়। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সামাজিকভাবে জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও জনসংখ্যার সবাইকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার সক্ষমতা অর্জন করেনি। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে মানের সংকট যেমন রয়েছে আবার অনেক শিশু কিশোরী প্রয়োজনীয় শিক্ষালাভের সুযোগ অর্জন করতে পারছে না। এর ফলে সমাজে ব্যাপক বৈষম্য, অদক্ষ জনগোষ্ঠী এবং নানা ধরনের কুসংস্কার ও অন্ধত্বের প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার মতো অপশক্তি সমাজের অভ্যন্তরে জন্ম নেয়। যারা দক্ষ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে ব্যর্থ হয় তারা সমাজে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। আমরা প্রতিনিয়ত যেসব ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মানুষজনকে দেখছি তাদের বেশিরভাগই শিক্ষা-দীক্ষায় তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। আবার অনেকে নানা ধরনের দুর্নীতি, শক্তির প্রয়োগ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে সমাজের বিত্তশালী হওয়ার অবস্থানে চলে যায়। এরা সমাজকে আরো বেশি অপরাধপ্রবণ ও কলুষিত করার ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখে। সে কারণেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে গত কয়েক বছরে যথেষ্ট উন্নতি ঘটানোর পরও সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে পড়ে আছি। বস্তুত আমাদের সমাজে একদিকে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দৃশ্যমান হলেও অন্যদিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হানাহানি, দখল এবং পশ্চাৎপদ চিন্তাধারার মানুষের বেড়াজাল ভাঙতে খুব একটা সফল হচ্ছি না। এর কারণ হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্বাধীনতার পর থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে উন্নত-আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার মতো সময়, সুযোগ, পরিকল্পনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালের পর সমাজকে উগ্র, হঠকারী এবং ধর্মান্ধতায় প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের যতটা সহযোগিতা ছিল তাতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আধুনিক রাষ্ট্র শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনবোধ থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়েছে। সে কারণে আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। ফলে সমাজের অভ্যন্তরে সুকুমার বৃত্তির চর্চা স্থান লাভ করতে পারেনি। এর ফলে আমাদের নতুন প্রজন্ম শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতিতে মেধা-মনন ইত্যাদির উৎকর্ষ সাধনে অনেকটাই বঞ্চিত হয়। এই বঞ্চিত জনগোষ্ঠী সমাজে জনগোষ্ঠীর পরিবর্তে অপশক্তির খপ্পরে পড়ে যায়। এই ধারা থেকে আমরা এখনো নতুন প্রজন্মকে মুক্ত করতে পারেনি। সে কারণেই বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠতে পারছে না। তাদের বড় অংশই প্রচলিত বিশ্বাস বোধ অনগ্রসরতা ইত্যাদিতে আটকে পড়েছে। এই অবস্থাকে ভেঙে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সে কারণেই আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে এখন জনসংখ্যার একটি বড় অংশই জনশক্তি হিসেবে বেড়ে উঠতে পারছে না, এই না পারা জনশক্তির মধ্যেই অপশক্তির প্রভাব ও বিস্তার বেড়ে চলছে। আমাদের শিশু-কিশোরদের শিক্ষালাভের জন্য যে ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র থাকার প্রয়োজন ছিল তা অনেকাংশে নেই। তবে শিক্ষা নীতিবিহীনভাবে অসংখ্য ধারা-উপধারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিশু-কিশোরদের মেধা ও মননের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানোর মতো পাঠক্রম নেই। আবার সরকারি নিয়ন্ত্রণে যেসব সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর মানের মধ্যে রয়েছে বিরাট তারতম্য। ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশু-কিশোর এবং তরুণদের শিক্ষায় প্রস্তুত করার মতো অবস্থান অর্জন করতে পারেনি। এর ফলে একটা বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে যায়। ঝরে যাওয়া এই শিক্ষার্থীদের বড় অংশই পরিবার এবং সমাজের জন্য উপযোগী হয়ে উঠতে পারে না। এদের মধ্যেই বখাটে, কর্মহীন, দক্ষতাবিহীনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে। গ্রামাঞ্চলে এখন কিশোর তরুণদের মধ্যে শিক্ষায় অকৃতকার্য ভবঘুরের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েই চলছে। এরা গ্রামীণ সমাজে বখাটে এবং উচ্ছৃঙ্খল হিসেবে জীবনযাপন করে। একটি পর্যায়ে এসে এরা স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সংগঠনের আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভ করে। যখনই এরা সেই সুযোগটি লাভ করে তখনই নানা ধরনের অপকর্ম, বলপ্রয়োগ, কিশোর গ্যাং, তরুণ গ্যাং ইত্যাদি গড়ে তুলতে মোটেও দ্বিধা করে না। এ ধরনের উঠতি ও বখাটে তরুণ নিজ নিজ এলাকার জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে বাংলাদেশে বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া কিশোর ও তরুণরাই এলাকায় নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে বেড়াচ্ছে। সেসব অপরাধের কিছু কিছু ঘটনা নানাভাবে বের হয়ে আসে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা এলাকায় দলীয় পরিচয়ে চাঁদাবাজি, মাস্তানি, ধর্ষণ, জমি দখল, সরকারি অনুদান লুটপাট ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে। অথচ কিশোর এবং তরুণরা যদি জীবনের শুরু থেকেই যথাযথ নিয়মে পড়াশোনা এবং পরিবারের দেখভালে লেখাপড়ার মাধ্যমে বেড়ে উঠত তাহলে এদের প্রায় সবাই জনশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের প্রয়োজনীয় দেখভালের অভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার স্বাভাবিক নিয়মশৃঙ্খলায় গড়ে ওঠার অভাব থেকে এরা বখাটে হয়ে ওঠার মধ্যে ঢুকে পড়ে। সে কারণেই বাংলাদেশে পুরুষ ছেলেদের মধ্যে অসাফল্যের হার অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং লেখাপড়ার সুযোগ সীমিত থাকায় বেশিরভাগ মেয়েই বাল্যবিয়ের শিকার হয়। অভিভাবকরা সামাজিক এসব সমস্যাকে অতিক্রম করার সাহস হারিয়ে ফেলেন। ফলে আমাদের প্রথম প্রজন্মের ছেলেরা যেমনিভাবে নিজেদের মেধা, মনন, দক্ষতা ইত্যাদিকে উচ্চতর পর্যায়ে বিকশিত করার ক্ষেত্রে ক্রমশ সীমিত পর্যায়ে চলে আসে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার গুণমানে যেভাবে বাড়ার কথা ছিল সেভাবে হতে পারছে না। সমাজে নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব বেড়েই চলছে। এর ফলে সমাজ একুশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদিতে যতটা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হওয়ার ধারণা করা হচ্ছিল বাস্তবে তার ধারে-কাছেও যাচ্ছে না। এছাড়া অর্থবৃত্তে একসময়ের অনুন্নত পরিবারগুলো যতটা উন্নতি লাভ করছে তাদের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি লাভ করার চেষ্টা সীমিত আকারেই দেখা যায়। কিশোর ও তরুণদের অনলাইন প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। বইপুস্তক পড়া, জ্ঞানবিজ্ঞানের খোঁজখবর নেয়া ও আগ্রহী হওয়ার প্রবণতা সেই তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে। বরং তাদের মধ্যে নানারকম অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধ্যান-ধারণা প্রবল হয়ে উঠছে। সমাজে নতুন প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদির প্রসার যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল সেটি মনে হয় হচ্ছে না। ফলে এই তরুণদের একটা বড় অংশই জ্ঞানবিজ্ঞানে পারদর্শী না হয়ে বরং বিমুখ মানসিকতায় বেড়ে উঠছে। আমাদের সমাজে এখন বিজ্ঞান চিন্তা তরুণদের মধ্যে প্রসারিত না হয়ে সীমিত হয়ে পড়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তাদের কাছে খুব বেশি ধরা দিচ্ছে না। নিজের দেশ এবং স্বাধীনতার ইতিহাস তাদের খুব একটা আকর্ষণ করছে তেমনটি মনে হয় না। সর্বত্র জ্ঞানচর্চায় মানের সংকট দৃশ্যমান হচ্ছে। অথচ তরুণদের বড় অংশই অনলাইনে বেশ সক্রিয় দেখা যায়। দেশ এবং বিদেশের নানা বিষয় নিয়ে তাদের নানা ধরনের উদ্ভট মতামত দেখা যাচ্ছে। কোনো বিষয়ই সম্ভবত গভীরভাবে জানা, বুঝা, চিন্তা করা নিজেদের যুক্ত করার তেমন কোনো আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। সমাজে নানা ধরনের গুজব অপপ্রচার ইত্যাদিতে অনেকের অংশগ্রহণ মতামত পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু জ্ঞানচর্চার প্রথাসিদ্ধ নিয়মে যুক্ত হওয়ার সংখ্যা খুবই কমে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এর ফলে সমাজের অভ্যন্তরে যে বিভাজন জনশক্তি ও অপশক্তির মধ্যে ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও সমাজের উত্তরণ কতটা ইতিবাচক হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তৈরি হচ্ছে। এখনই নীতিনির্ধারকদের বিষয়গুলো নজরে নেয়া এবং করণীয় নির্ধারণ করা জরুরি বলে মনে করি। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App