×

জাতীয়

বৃহৎ ঋণ জালিয়াতরা অধরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২১ এএম

দুদকের সদিচ্ছার ঘাটতি দেখছে টিআইবি

অধরাই থেকে যাচ্ছেন দেশের ইতিহাসে বড় কেলেঙ্কারির নেপথ্য নায়করা। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইনের মারপ্যাঁচে বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না তাদের। বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকসহ কয়েকটি বড় জালিয়াতির হোতা হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা এখনো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশে। ব্যাংক খাতের জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্ত করলেও অদৃশ্য ইশারায় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন এসব প্রভাবশালী। তবে দুদক কঠোর পদক্ষেপ নিলে এসব পলাতক আসামিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক কেলেঙ্কারির অনন্য নজির হলমার্ক গ্রুপ। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখাসহ কয়েকটি শাখার মাধ্যমে আড়াই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এই বিজনেস গ্রুপ। সে কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন কবিরসহ ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ২০১২ সালে ৩৮টি মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১৪ সালে ১১টি মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এসব মামলায়ও ২০১৬ সালের মার্চ ও ফেব্রুয়ারিতে চার্জ গঠন হয়। এ ঘটনায় হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরসহ অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই। দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে গা-ঢাকা দেন তারা। জানা গেছে, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন হুমায়ুন কবির। তার পরিবারের সদস্যরাও কখনো কানাডায় কখনো মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করেন।

বেসিক ব্যাংক ইস্যুতে অনেক আলোচনা রয়েছে। ব্যাংকটির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারিতে দুদকের দায়ের করা মামলার আসামি ১২০ জন। বছরের পর বছর কেটে গেলেও দুদকের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নাম আলোচনায় এসেছে বারবার। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কার দুর্নীতির সব আলামত, দলিল, কাগজপত্র দুদকের হাতে। সে সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ও অর্থ আত্মসাতে যোগসাজশ থাকা ব্যাংকের গুলশানসহ কয়েকটি শাখার দুর্নীতি সংক্রান্ত সব নথিও রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাদের ফাইলে। এরপরও তদন্তের কোনো ক‚ল-কিনারা হয়নি। বর্তমানে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি মামলার তদন্ত করছেন। ২০১৫ সালের ২১-২৩ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৫৬টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় বেসিক ব্যাংকের ২৭ কর্মকর্তা, ১১ জরিপকারী ও ৮২ ঋণগ্রহণকারী ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ১২০ আসামির মধ্যে ১৪ জনকে বিভিন্ন সময় দুদক গ্রেপ্তার করলেও বর্তমানে সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে কারাগারের বাইরে আছেন। এছাড়া আসামিদের মধ্যে অনেকেই দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

৩৬শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার কানাডায় চম্পট দেন। অভিযোগ রয়েছে, পি কে হালদার পিপল্স লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) দায়িত্ব পালন করে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন। ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। মামলার এজাহারে পি কে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার লেনদেনের বিষয়ে তথ্য ছিল।

দুদক ও বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন পি কে হালদার। দুদকের অনুরোধে পি কে হালদারের অপকর্মের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিএফআইইউ। এই প্রভাবশালী ব্যাংকারের সম্প্রতি দেশে ফেরার বিষয়ে নানা নাটকীয়তা চলমান রয়েছে।

ক্রিসেন্ট গ্রুপ পরিবারের অন্যতম সদস্য আবদুল আজিজ। হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, আজিজের পুরো পরিবারের হাতে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ওই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ। দেশীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধারও তিনি। দুদক সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি না করেও ভুয়া রপ্তানি বিলের মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে সংস্থাটি। এ মামলায় অন্যতম প্রধান আসামি রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ। মামলার এজাহারে ক্রিসেন্ট লেদারের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। ক্রিসেন্ট ট্যানারির বিরুদ্ধে ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার ১২০ টাকা, লেসকো লিমিটেডের ৭৪ কোটি ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৯ টাকা, রূপালী কম্পোজিট লেদারের ৪৫৪ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮৪ টাকা এবং রিমেক্স ফুটওয়্যারের বিরুদ্ধে ৬৪৮ কোটি ১২ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এ মুহূর্তে দুদক আবদুল আজিজকে গ্রেপ্তারের জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে এই ব্যক্তি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে পলাতক থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে সরব আজিজ। সম্প্রতি তিনি ফেসবুকে এক পোস্টে হলিউডে সিনেমা নির্মাণের ঘোষণাও দেন।

স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। পুরো স্বাস্থ্য খাতে বিস্তৃত মিঠুর জাল। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা পথে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক তিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ঔষধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদপ্তর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। তারা মিঠুর হয়ে কাজ করে। স্বাস্থ্য খাতে মিঠু মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ইউনিয়নে। মিঠু বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকেন। তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্য খাত। বিদেশেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।

২০১৬ সালের ৯ মে প্রকাশিত বহুল আলোচিত পানামা পেসার্স কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারী হিসেবে মিঠুর নাম আসে। গত অর্ধযুগে দুদক তার বিরুদ্ধে কয়েক দফায় তদন্তের উদ্যোগ নিলেও কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোনো নোটিস হলেই হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মিঠু। পরে সেটি নথিভুক্ত করার মাধ্যমে ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি’- করিয়ে নেন। মিঠুর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত একটি ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করেছে দুদক। ২০১৬ সালের ১০ মে বনানী থানায় মামলাটি করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক। গত দুই বছরে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দুদক অনেক অনুসন্ধান করলেও মিঠু রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি দুদকের সুপারিশের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করেছে সেখানে মিঠুর একটি প্রতিষ্ঠানেরও নাম নেই।

স্কুলের চাকরি থেকে ঠিকাদারিতে নাম লেখান স্বাস্থ্য খাতের আরেক ডন জাহের উদ্দিন সরকার। ধীরে ধীরে তার পুরো পরিবারকে ঠিকাদারির সঙ্গে সম্পৃক্ত করান। দুদকে রয়েছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। জানা যায়, জাহের ঠিকাদারি করে বাড়ি কিনেছেন অস্ট্রেলিয়াতে, সেখানে রয়েছে ব্যবসাও। তার এক স্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার ওই বাড়িতে থাকেন এবং তার সেখানকার ব্যবসা দেখাশোনা করেন। দেশে থাকেন আরেক স্ত্রী। সাবেক স্কুল শিক্ষক জাহেরের সম্পদের পরিমাণ কত তার সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ঠিকাদার চক্র গঠন করে জাহের এখন শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকা ও দিনাজপুরসহ দেশে-বিদেশে রয়েছে তার সম্পদের পাহাড়। তিনিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরখাস্ত হওয়া হিসাবরক্ষক আবজালের (বর্তমানে কারাবাসে থাকা) মতো বিপুল সম্পদের মালিক।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, অর্থ লোপাট করে যারা দেশ-বিদেশে আত্মগোপনে আছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে দুদক। কেউ আইনের উর্ধ্ব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। আসামিরা যেসব দেশে রয়েছে, আমরা ওই সব দেশের সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মামলার প্রয়োজনে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনব। এছাড়া দুর্নীতি মামলার আসামিরা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য ইমিগ্রেশনে নিষেধজ্ঞাসহ তাদের ওপর নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারার পেছনে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের একাংশের দক্ষতা, সৎ সাহসিকতা ও সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। আর দুদকের অনুসন্ধান-তদন্তের পুরো বিষয়টাই হচ্ছে সংস্থাটির এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য অবৈধ সম্পদ আহরণের সুযোগ। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো আসে, তখন দুদক কর্মকর্তাদের একাংশ ওই সব দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আঁতাত ও যোগসাজশের মধ্যে চলে যায়।

এ কারণে দেখা যায়, মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে যায়। তখন ওই সব মামলার বাস্তবে আমরা কোনো সুরাহা দেখতে পাই না। এছাড়া ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী আসামিদের বিরুদ্ধে দুদক সক্রিয় হতে পারে না এবং এক্ষেত্রে তারা সৎ সাহসিকতাও দেখাতে ব্যর্থ। যদি দুদক কঠোরভাবে পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু দুদকের সেই সদিচ্ছা আছে কিনা, সেটাই প্রশ্ন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App