×

মুক্তচিন্তা

প্রধানমন্ত্রীর আস্থা বধূ-মাতা, বহ্নিশিখায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২০, ১১:২৩ পিএম

নারীদের আরো এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েই আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আহ্বানটাকে আরো খোলাসা করেছেন গত ৭ নভেম্বর ৪৯তম জাতীয় সমবায় দিবস পুরস্কার অনুষ্ঠানে। আহ্বাননের সঙ্গে তার বিশ্বাসের কথাও জানিয়েছেন। বলেছেন : ...সমাজের অর্ধেকই তো নারী। নারীরা এগিয়ে এলে দুর্নীতি একটু কমবে। কাজ বেশি হবে। প্রতিটি পরিবার উপকৃত হবে। নারীদের সঞ্চয়ীগুণের কথা বলতে গিয়ে তাদের সমবায়ে বেশি করে সম্পৃক্তের পরামর্শও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একেবারে বাতকে বাত, রাজনৈতিক কথার কথা বা কথাচ্ছলে প্রধানমন্ত্রী এমন বিশ্বাসের জানান দিয়েছেন ভাবা যায় না। এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ নিশ্চয়ই তিনি জানেন, রাখেন। আর উপরোক্ত আস্থা ও আহ্বানের মধ্য দিয়ে নারীদের দায় বাড়িয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। আর সেটা করেছেন দায়িত্ব নিয়েই। সাধারণ দৃষ্টিতেও আমরা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় মেয়েদের সাফল্য দেখছি। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায়ও এগিয়ে থাকা। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়, বেসরকারি বা করপোরেট অফিসগুলোতে নারীদের দক্ষতা ঈর্ষণীয়। কাজে একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, অফিস পলিটিক্স এড়িয়ে চলা, দুর্নীতিতে গা না মাখা নারীর সংখ্যা প্রচুর। দু’চারটা নেত্রী পাপিয়া, ডা. সাবরিনা, আমলা সুলতানা বাদ দিলে উপরোক্ত তথ্যের সঙ্গে কারো তেমন দ্বিমত থাকতে পারে না। পাপিয়া, সাবরিনা, সুলতানারা মোটেই নারীর প্রতীক নয়। অনুকরণীয়ও নয়। হোক না কারো কন্যা, বধূ, জায়া-জননী। শুধু হত্যা নয়, জঙ্গিবাদ, মানব-স্বর্ণ পাচার, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা, শিশু চুরি, ছিনতাই ও অপহরণের মতো জঘন্য কুকর্মেও নারীদের সম্পৃক্ত করার পেছনে কারা-কীভাবে জড়িত? সেই আলোচনা এখন তোলাই থাক। গড়পড়তা নারী কোনো অপরাধে জড়িত থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এই বিশ্বাসকে ঠাণ্ডা মাথায় কাজে লাগায় অপরাধী চক্র। তারা অবলা বধূ-মাতা, জায়া-জননীদের চক্রভুক্ত করে নানা ছলে-কৌশলে। জন্ম দেয় পাপিয়া-সাবরিনাদের। প্রীতিলতা, ফয়জুন্নেসা, রোকেয়া, সুফিয়া কামাল জন্ম দেয় না। এর জেরে পাচারকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে থাকা নারী সদস্যরা ফুসলিয়ে, ভালো কাজের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন বয়সি নারীকে পাচারের ফাঁদে ফেলে। মুখোশ পরে তারা কোনো বড় অপরাধীকে সাহায্য করে, নয়তো নিজেই জড়িয়ে পড়ছে। এদের মুখোশটা উন্মোচন হলে নারীদের দিয়ে অপরাধ করা বা করানোর সুযোগটা কমে আসত। কে না জানে, কোনো কোনো নারীকে তার জন্মের আগে থেকেই লড়াই শুরু করতে হয়। সেখানে নারীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা যেন ফিনিক্স পাখির জন্মকেও হার মানায়। এই বাস্তবতা স্মরণে রেখে কার্যকর নারী জাগরণ জরুরি। জাগরণ মানে বোধ-বুদ্ধির বিকাশ। কিন্তু নারীরা কি যথার্থভাবে জাগছেন? চেতনায় চেতন আসছে? বুঝতে পারছেন আসলটা? প্রধানমন্ত্রীর বার্তাটা? মোক্ষম ইস্যুর চেয়ে খুচরা-মামুলি ব্যাপারে ক্ষেপণ-চেতন মানুষকে কখনো কখনো বিরক্ত করছে। অন্যদিকে চলমান ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পাচার, অপহরণ, নিখোঁজ ইত্যাদি বালামছিবত নিয়ে কোনো অবেলায় না ঠেকিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের। এ নিয়ে নেত্রীদের কার্যকর কোনো আওয়াজ কি আছে? মাঝেমধ্যে মানব-মানবী মিলে মানববন্ধনের নামে শোডাউন ছাড়া? প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিখ্যাত গান/কবিতা জাগো নারীতে নারীদের জাগানোর নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। নারীদের তিনি ডেকেছেন বহ্নিশিখা, দাহিকা, ধূমায়িত অগ্নি, স্বর্গ-স্খলিতা, জয়ন্তিকা ইত্যাদি কত সোহাগী নামে। নারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, আহ্বানের সঙ্গে কাজী নজরুলের বিখ্যাত লেখার কয়েক লাইন এখানে টেনে আনতেই হয়। জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্ত-টিকা। দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্বসনা জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা। ধু ধু জ্বলে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী! পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা। পটিয়ে-পাটিয়ে হলেও প্রকৃত অধিকারের ব্যাপারে নারীদের বোধ-বুদ্ধি কদ্দূর জাগাতে পেরেছেন? নজরুলের পরবর্তী কোনো লেখনীতে তার ফলোআপ নেই। থাকলেও জানার বাইরে। নজরুল গবেষকদের কারো লেখায় তেমন কিছু চোখে পড়েনি। নারীবিষয়ক সাহিত্যসহ সৃষ্টিকর্মের বাজার ভালো। পাঠক, দর্শক, শ্রোতা প্রচুর। একসময় সিগারেটের বিজ্ঞাপনে মেয়েদের অপব্যবহারে কষ্ট পেয়ে ওই মডেলকেই বলার চেষ্টা করেছিলাম, নারীদের অপমানের কথাটা। তিনি ভীষণ মাইন্ড করেছেন আগুনমুখী হয়ে। খেয়াল করেছি, অপব্যবহারের পণ্যতেই কী গর্বিত তিনি। পরে সেই কষ্ট একেবারে থমকে দিয়েছে বেøডের বিজ্ঞাপনেও নারীর ব্যবহার। শিক্ষায় বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি বড়াই করার বিষয়। নারীর ক্ষমতায়ন তো অবশ্যই গর্বের ব্যাপার। এর বিপরীতে ঠকাঠকির কিছু কায়কারবারও ঘটে চলছে। জিততে গিয়ে কি হারে ঠকছেন তা বললে তো ক্ষেপে যাবেন মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নীরা। বোঝা দূরে থাক, শুনতেও চাইবেন না। কিছু কেস স্টাডিতে দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগই নিজের পাতে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তুষ্টি পান। হেরেও নিজেকে বিজয়ী ভাবেন। স্বস্তি পান মানুষ না হয়ে মেয়ে মানুষ হতে। ম্যান নয়, ওম্যান হতে গরজ বেশি। হাজব্যান্ড শব্দটির অর্থ যে পালনকারী তা ওয়াইফরা মাথায় নিতে চান না। এ তরজমার বিরুদ্ধে কোনো নারীকে আজতক শক্ত আপত্তি করতে শুনিনি। অভিধানে নারী শব্দটির প্রতিশব্দগুলোর মধ্যে একটি ভার্যা। এর অর্থ ভরণীয়া। অর্থাৎ যাকে ভরণ করাতে হয়। ভৃত্য এবং ভার্যা শব্দ দুটির উৎপত্তিগত অর্থ একই। আজ পর্যন্ত কোনো নারী এর প্রতিবাদ করেছেন? জানি না। শুনিওনি। এছাড়া যুগে যুগে করা অশালীন মন্তব্যে বধূ, জায়া, ভগ্নীরা নাখোশ হয়েছেন এমন তথ্যও কম। বাধ্য হয়ে এখানে সেরকম লেখার কিছু অংশ বা মন্তব্য উল্লেখ না করে কোনো উপায় দেখছি না। যেমন ১) মেয়ের সম্মান মেয়েদের কাছেই সবচেয়ে কম। ... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২) বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের চুইংগামের মতো চাবাতে ইচ্ছে করে । ... অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ৩) কম বয়সি মেয়ে হলো রসগোল্লার মতো, যেখানে রাখবে সেখানেই পিঁপড়ে ধরবে।... শংকর ৪) পৃথিবীতে বা সমুদ্রে যত হিংস্র প্রাণী আছে, সবচেয়ে বৃহত্তম প্রাণী হলো মেয়েরা।... মেনানডার ৫) পুরুষরা মেয়েদের খেলার সামগ্রী এবং মেয়েরা শয়তানের খেলার সামগ্রী। মেয়েরা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বৈ কিছু নয়।... নেপোলিয়ান ৬) মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললেই তো পার, ফ্রিতেই যদি গাভীর দুধ মেলে তাহলে কোন মূর্খ টাকা খরচা করে ঘরে গাই পোষে? ... সমরেশ মজুমদার রোমান্সের কাতরতায় কবি-লেখকরা নারীদের কীভাবে চিত্রিত করেছেন সেটার সমীকরণ মেলানো কঠিন। নারীর মনস্তত্তে¡ কীভাবে তা ঢালা হয়েছে সেই হিসাবটাও গোলমেলে। এমন সব লেখার প্রতিবাদ কোনো নারী করেছেন? অপমানিত হয়েছেন? পাল্টা লেখাও কি কিছু লিখেছেন কোনো নারী? বরং যেন প্রশংসা মনে করেই স্বস্তি, হাততালি। বেহুদা খুশিতে বগল বাজানো। শ্রদ্ধা-সম্মান পায়ে দলে কখনো আধুনিকতা, কখনো ভালোবাসা, কখনো আবেগের উসকানিতে তারা বিমোহিত। সব সুখ কি তেল-সাবান-গহনা, টিভি সিরিয়াল, স্কুলের সামনে ভাবিদের সঙ্গে আড্ডা-আউটিং, শপিং, পার্লার, জিরো ফিগার, ব্যাংস কাট আর হট পিংক লিপস্টিক, নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বামীর মানিব্যাগ নিয়ন্ত্রণ, সাধ্যে কুলালে একটা ফ্ল্যাটের দলিল হস্তগতের মধ্যেই? সুখের অন্য কোনো বিষয়-আসয় কি আর নেই? প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এই আহ্বান, মূল্যায়ন তথা অভিমতের পর উপরোক্ত প্রশ্নগুলো খুব প্রাসঙ্গিক অবশ্যই। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App