×

জাতীয়

পাওনা না পেয়ে তাজরীনের শ্রমিকরা অবস্থান কর্মসূচিতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২০, ১১:১৩ এএম

পাওনা না পেয়ে তাজরীনের শ্রমিকরা অবস্থান কর্মসূচিতে

তাজরীন ফ্যাশনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের পুনর্বাসন এবং সু-চিকিৎসার দাবিতে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শ্রমিকরা -ভোরের কাগজ

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ৮ বছর পরও আহত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পায়নি। শ্রম আদালতে মামলা করেও সাড়া পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা। বরং একাধিক শ্রমিক সংগঠন ও এনজিও আহত শ্রমিকদের পাওনা আদায়ের কথা বলে আন্দোলনের নামে তাদের ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আহতদের মধ্যে ৪৫ জনের জীবন এখন দুর্বিষহ। কর্মক্ষমতা হারানো এসব অসহায় শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আয়-রোজগার না থাকায় তাদের দিন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে। নিরুপায় শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদি সুচিকিৎসার দাবিতে ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের ফুটপাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। অনেকে অসুস্থ হয়ে সেখানেই শয্যাশায়ী হলেও খোঁজ নিচ্ছে না কেউ।

৩ অক্টোবর প্রথমে ২৬ জন এবং পরে ১৯ জন মিলে ৪৫ জন অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। তারা সবাই ওইদিন অগ্নিকাণ্ডের সময় আহত হন। এরপর চিকিৎসা নিয়ে প্রাণে বাঁচলেও তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, হারিয়েছেন কর্মশক্তি।

এদিকে আলোচিত তাজরীন ফ্যাশনের মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন ইতোপূর্বে রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও সম্প্রতি মৎস্যজীবী লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের রাজনীতিতে নাম লেখিয়েছেন বলে নিজেই ফেসবুকে প্রচার করছেন। মৎস্যজীবী লীগে তার নাম লেখানো নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন পাওনা বঞ্চিত শ্রমিকরা।

তাজরীন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ার হোসেন তোবা গ্রুপেরও কর্ণধার। তার ১৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আশুলিয়ার কাঠগড়া, ঢাকার মেরুল বাড্ডা ও হোসেন মার্কেট এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। চট্টগ্রামেও রয়েছে তার ব্যবসা। সেখানে প্রতারণার মামলায় আটকের পর আদালতের মাধ্যমে ১ দিন পর ছাড়া পান দেলোয়ার।

তাজরীন দুর্ঘটনায় আহত মোসা. জরিনা বেগম জানান, ৮ বছরেও তাজরীনের মালিক তাদের কোনো সহায়তা দেয়নি। আইনের ফাঁক গলিয়ে তিনি আছেন বহালে। গার্মেন্টস ব্যবসা চলছে দিব্যি। অথচ ওইদিনের ঘটনায় আহতরা অনিশ্চয়তার মধ্যে অমানবিক জীবনযাপন করছেন।

জরিনার দাবি, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আওয়াজ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তারা শ্রম আদালতে মামলা করেন। সেখানে তাদের দুবার ডেকে সাক্ষ্য নেয়া হলেও পরে সব পাল্টে গেছে। তার দাবি, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের আমিনুল হক আমিন, আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নাজমা আক্তার, বিসিডবিøওএসের বাবুল আক্তার ও কল্পনাসহ কয়েকজন তাদের ব্যবহার করে দেশ-বিদেশ থেকে টাকা হাতিয়েছেন। তার দাবি, তাজরিনের মালিক দেলোয়ার এখন মৎস্যজীবী লীগের নেতা। ফেসবুকে তিনি নিজেই এমন প্রচার করছেন বলে দাবি করেছেন জরিনা। তাজরিন দুর্ঘটনায় আহত সুমি নামে এক শ্রমিককে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে বায়ারদের সঙ্গে কথা বলান। কিন্তু আহত শ্রমিকরা মিথ্যা আশ্বাস ছাড়া কোনো সহায়তা পায়নি। রেহেনা আক্তার বলেন, বিজিএমইএ ও বিলস নামে এনজিও প্রথমে আহতদের চিকিৎসা করালেও পরে তাদের দিন কাটছে দুর্বিসহ। ওষুধ কেনার টাকা নেই, তাদের জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে।

আলেয়া আক্তার জানান, নিহতরা ৮ লাখ টাকা করে পেয়েছেন। আহত ১৭৩ জনকে বিদেশি সংস্থা থেকে ১ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করে দিয়েছে। নাসিমা আক্তার জানান, তাজরিনে ৫ হাজারের মতো শ্রমিক থাকলেও ওইদিন প্রথমার্ধে এক গ্রæপের ছুটি হয়ে যাওয়ায় ঘটনার সময় ছিল ২৪শ শ্রমিক। ঘটনার সময় ১১২ জন পুড়ে অঙ্গার হলেও পরে মারা যায় আরো ১০ জন। এছাড়া আহত হন কয়েকশ। আহতদের মধ্যে অনেকে কাজ করার শক্তি হারিয়েছেন। আহতদের সবার জীবনের গল্প এখন একই। অনেকে এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে দুর্ঘটনার ক্ষতচিহ্ন। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণায় ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন যখন তখন। আগুন লাগা ভবনের সিঁড়ি তালাবদ্ধ ছিল।

অবস্থান কর্মসূচিতে থাকা বানু বেগম বলেন, আমরা আগুনের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে কারখানাটির ৫, ৪ ও ৩ তলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়তে বাধ্য হই। তিনি বলেন, আমাদের অনেকেরই মেরুদণ্ড, ঘাড়, মাথা, হাত ও পা ভেঙে মারাত্মক আহত হই। এছাড়া ১১২ জন মারা যায়। মারাত্মক আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে আমরা আজও বেঁচে আছি। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারছি না। সুমি আক্তার জানান, ওইদিন ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। মেরুদণ্ডে আঘাত পান, হাত কেটে যায়। এরপর অনিশ্চিত জীবন নিয়ে অজানা সংগ্রাম। তিনি বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে বর্তমানে আমাদের জীবন কাটছে অত্যন্ত অমানবিক এবং অনাহারে-অর্ধাহারে।

বানু ও সুমির মতো অসহায় আঞ্জুমান আরা, হাসি, মাতা বেগম, রাজ বানু, আসাদ, মোক্তার হোসেন, মোকাদ্দেসের জীবনের গল্প এক ও অভিন্ন। তারা বলেন, শুরু থেকেই আমরা আমাদের সুচিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। ক্রেতা সংস্থাসহ অনেকেই তখন সুচিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার, অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ৪ বছর পর আমাদের দেয়া হয় সামান্য অনুদান, সেখানেও নিদারুণ বৈষম্য। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, অবস্থান কর্মসূচির মধ্যে বিজিএমইএ প্রতিনিধি ও গোয়েন্দারা তাদের নামের তালিকা নিলেও কার্যত কোনো সুখবর নেই।

অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে তাজরিন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ার হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করে এবং এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, তাজরিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়। ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এ কে এম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে চার্জশিট দেন। এতে তাজরিন ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ প্রতিষ্ঠানটির ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু দেলোয়ার আছেন বহালে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App