×

মুক্তচিন্তা

একজন সংশপ্তকের প্রতি বিদায় সম্ভাষণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২০, ১১:৫৪ পিএম

একজন সংশপ্তকের প্রতি বিদায় সম্ভাষণ
বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেইদিন হ’ব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ ভীম রণভ‚মে রণিবে না! মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেইদিন হ’ব শান্ত! (বিদ্রোহী : কাজী নজরুল ইসলাম) নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার শেষ পঙক্তি ক’টি পড়ে বুঝি, বিদ্রোহী ক্ষান্ত হওয়ার নয়; সে লড়ে যাবে ততদিন, যতদিন নির্যাতিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তি না আসে। অর্থাৎ দ্রোহী আমৃত্যু লড়ে যায়। যিনি হার না মেনে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়ে যান তিনিই সংশপ্তক। সংশপ্তকের জন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেন উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। একজন সংশপ্তকের কথা বলার জন্যই আজকের রচনা। মূলে প্রবেশের আগে ছোট্ট একটু ভ‚মিকা করছি। বেশ ক’বছর আগে এক সাহিত্যানুষ্ঠান শেষে টেবিলে আমি একটা চমৎকার-দামি কলম পেলাম; কিন্তু কলমটা কার জানা হলো না। মঞ্চে আমার পাশে আরো কয়েকজন ছিলেন; ভাবলাম খোঁজ করে ফেরত দেবো। কলমটার প্রতি আমার কিঞ্চিৎ লোভও জন্মেছে, তখন জানলাম, কলমটি আমার বন্ধু তৎকালীন কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহীত উল আলমের। অতঃপর কয়েকদিন পর তাকে আমি কলমটা ফেরত দিতে গেলাম। উনি হেসে বললেন, ‘ফরিদ ভাই, কলমটাতে তো কালি নেই। ওয়ানটাইম কলম, ও দিয়ে আর কী হবে?’ আমি বোকা হয়ে রইলাম। কলমটি আমি অবশ্য ফেলে দিইনি; বন্ধুর স্মৃতি ভেবে রেখে দিয়েছি। ওয়ানটাইম সংস্কৃতির কথা একবার লিখেছি, সুতরাং ও নিয়ে আর সময় নষ্ট করতে চাই না। তারপরও কয়েকটি কথা বলি; আমাদের চারপাশে আমরা যত মানুষ দেখি, তার অধিকাংশই ওয়ানটাইম মানুষ; হয়তো কারো বিপুল সম্পদ আছে, বিশাল বাড়ি-গাড়ি-প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী; হয়তো কারো কথায় বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল পান করে; চারদিকে সবাই তার স্তবকতায় ব্যস্ত; কিন্তু বিপাকে পড়লে জানা যায়, কতটা অন্তঃসারশূন্য সে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনো সম্রাট বা যুবরাজ সেলিমকেও তো দেখলাম। তার আগেও আমরা দেখেছি তারেক-ফালু গংয়ের দাপট। যা হোক, ওইসব ওয়ানটাইম দুর্বৃত্তদের নাম আলোচনা করে কালক্ষেপণ করতে চাই না। আমার আলোচনা একজন সংশপ্তককে নিয়ে, যিনি ক’দিন আগেই প্রয়াত হলেন। না তিনি সমাজে তেমন কোনো কেউকেটা ছিলেন না, অতিশয় সাদামাটা জীবনের মানুষ ছিলেন। বিপুল সম্পদ, বিশাল বাড়ি-গাড়ি-প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারীও ছিলেন না; কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তার কীর্তির দৃশ্যমান যা কিছু, তা যেমন তার কথা মনে করাবে সবাইকে, যা কিছু চেতনাগত তাও তাকে চিরজীবিত করে রাখবে। একবার যদি চোখ বন্ধ করে তাকে স্মরণ করা যায়, বোঝা যাবে কতটা কীর্তিমান ছিলেন তিনি! তার মতো অমন কীর্তিমান পুরুষ গত শতাব্দীতে তার জনপদে জন্মগ্রহণ করেননি। মানব জন্মের গৌরব কোথায়? বিষয়টির ব্যাখ্যায় বিভিন্নজন নিশ্চয়ই নিজের মতো করে বলবেন; আমার ব্যাখ্যা হয়তো আপনার সঙ্গে মিলবে না; কিন্তু তাই বলে আপনার ব্যাখ্যাকে বাতিল করে দিয়ে আমার ব্যাখ্যাই শেষ কথা, তেমনটি আমি ভাবছি না; আপনার কাছ থেকেও কি আমি একই আচরণ প্রত্যাশা করতে পারি না? এভাবেই একজন অন্যকে বিবেচনার মধ্যেই আমি মানবিক সৌন্দর্য দেখতে পাই। আমি মনে করি একজন মানুষ পৃথিবীতে তার জীবনযাপন আর কর্মতৎপরতায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এমন কিছু আয়োজন রেখে যাবেন, যেন পরবর্তীকালের মানুষ তাকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। মানুষের জীবনের আনন্দ তখনই, যখন সে তার ব্রত আর কর্মোদ্যোগে পরিতৃপ্তি খুঁজে পায়। পৃথিবীর মানুষ হয়তো তার ক্লেশ, সাফল্য পাওয়ার নিরন্তর সংগ্রাম দেখে ভাবে, লোকটা কত অসুখী; কিন্তু তার তো ‘পথ চাওয়াতেই আনন্দ!’ তিনিই হয়ে ওঠেন সর্বকালের দ্রোহী মানুষের দৃষ্টান্ত। না, পৃথিবীর সব মানুষই তা করতে পারবেন, সেটি সম্ভব নয় কাক্সিক্ষতও নয়। সেই যে আলেক্সান্ডার সেলক্রিকের কবিতা, ‘হ্যাপি দ্য ম্যান’, যেখানে কবি বলেছেন, সে-ই সুখী মানুষ, যিনি নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয় করবেন না; যিনি কারো মুখাপেক্ষী হবেন না; কারো সাতেপাঁচে যাবেন না; নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকে একদিন চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়বেন। সন্দেহ নেই, তেমন মানুষ সুখী মানুষই হবেন; কিন্তু যাপিত জীবন অতিক্রমণের পর, তিনি উপাচার্যের ওই কলমটির মতো অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবেন; মৃত্যুর পর পৃথিবী থেকে মুছে যাবেন। কিন্তু কিছু মানুষ হয়তো সাধারণের বিবেচনায় যাপিত জীবনে সুখ ভোগ নাও করতে পারেন; অথচ তার কীর্তি মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও ভাবনায় রাখবে মানুষকে; তার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে মানুষ। ধরা যাক রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব; এরা যাপিত জীবনে কে কতটা সুখী হয়েছিলেন আমরা জানি না; কিন্তু তাদের প্রয়াণের দীর্ঘদিন পরেও মানুষ উন্নততর চিন্তা, পরিশীলিত জীবনের প্রয়োজনে শরণাপন্ন হচ্ছে তাদেরই। ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত/ পাঠায়েছ বারে বারে/ দয়াহীন সংসারে/ তারা বলে গেল, ক্ষমা কারো সবে/ বলে গেল ভালোবাসো,/ অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো।...... আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন/ শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী, নিরবে নিভৃতে কাঁদে।.... যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু/ নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ/ তুমি কে বেসেছো ভালো?’ রবীন্দ্রনাথের মতো করে ঈশ্বরের প্রতি এমন প্রশ্ন ক’জন করতে পারেন? তাই তো তিনিই বলতে পারেন ‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম/ আপনার রূপ,/ চিনিলাম আপনারে/ আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়; সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,/ সে কখনো করে না বঞ্চনা।/ না, তিনি সৃজন অঙ্গনের মানুষ নন, কিন্তু শিল্পাঙ্গনের মানুষ অবশ্যই; তাই তার উপলব্ধিতে সবসময়ই কাজ করেছে রবীন্দ্রনাথের উত্থাপিত প্রশ্ন; আর তিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন শিষ্ট-ভব্য-রুচিস্নিগ্ধ মানুষ তৈরির ব্রত নিয়ে। তার শিশু-কিশোর সংগঠনের কর্মীদের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করেন সম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার জন্য। বিশ্বব্যাপী আজ তার হাজার হাজার ছাত্র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মে অবদান রেখে গেছেন। অর্ধ শতাব্দীকালের বেশি সময় ধরে তাকে মানুষ দেখেছে, তিনি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন! এক জীবনের সাধনায় তিনি এমন এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন; যা কেবল এক জনপদে নয় বরং সমস্ত বঙ্গ দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো। তার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সে জনপদের বিভিন্ন অঙ্গনের শিল্পীরা খুঁজে পেল পথের দিশা; মিতালী মুখার্জী, বিপুল ভট্টাচার্যের মতো শিল্পীদের বিকশিত হওয়ার পেছনে তার অবদান অবিস্মরণীয়! নিজ জনপদ এবং জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে তার ভ‚মিকা ঈর্ষণীয়। ১৯৬৫-তে পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৯০-এ বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রশ্নে সৃষ্ট উত্তেজনায় সংখ্যালঘুদের জান-মাল রক্ষার্থে তিনি রাত জাগেন; সেসব মানুষের দেখা। এখানে সব তথ্য বিস্তারিত উপস্থাপনের সুযোগ নেই। সময় সুযোগে সেসব তথ্য নিশ্চয়ই উপস্থাপনের উদ্যোগ নেবো। কিন্তু আমার আজকের রচনার উদ্দেশ্য তাহলে কী? না, তার কীর্তি-কীর্তণ নয়; আমার রচনায় তার বিকশিত হওয়ার অবকাশ নেই; কিন্তু যাপিত জীবনে যে কীর্তি তিনি রেখে গেলেন, তা আমাদের এবং এ দেশের আগামী প্রজন্মের শিষ্ট-ভব্য-সম্পন্ন-সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠার স্বার্থে কতটা ব্যবহার করতে পারি সেটাই প্রশ্ন। প্রয়াণের পর আবেগবশত তাকে সৌজন্য সম্মান দেয়া যেতেই পারে; কিন্তু তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তাকে স্মরণ করে যদি নিজেদের সামান্য শিষ্ট করে তুলতে পারি; কেন সে উদ্যোগ নিতে আমরা দ্বিধা করব? তার প্রতিষ্ঠান মুকুল ফৌজ কেন্দ্রের শাখা সংগঠন হলেও, তার সাধনায় ছাড়িয়ে যায় কেন্দ্রকে। তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুকুল নিকেতন উচ্চবিদ্যালয় সারাদেশে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে তার আত্মনিবেদনের কারণেই। তার প্রয়াণের পর মুকুল ফৌজ বা মুকুল নিকেতন তার ম্যুরাল করবে না-কি ভাস্কর্য করবে সেটা তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়; কিন্তু তার কর্মাঙ্গন ময়মনসিংহের মানুষ কীভাবে তাকে স্মরণ করবে? কীভাবে তার স্মৃতিকে ধারণ করে আগামীর শোভন সড়ক প্রস্তুত করবে, প্রশ্ন সেটি। আমরা যারা মূল্যবোধ-মূল্যবোধ বলে চিৎকার করি, তারা কি একবারো ভেবে দেখেছি, দেশের বিভিন্ন জনপদে তার মতো কৃতীমানুষ, কিংবদন্তিতুল্য যারা; তাদের জীবদ্দশায় অথবা মরণোত্তর কতটা সম্মান দেখিয়েছি? তার স্বার্থে নয়, নিজেদের সুন্দর জীবন প্রত্যাশায় আমাদের কি উচিত নয় তার মতো সংশপ্তককে অর্চনা করা? এমন সোনার মানুষগুলোকেও যদি আমরা ওয়ানটাইম ভাবতে চাই; তারচেয়ে দুর্ভাগ্যের কী আর হবে? এতক্ষণ ধরে আমি যে সংশপ্তকের কথা বলতে চাইলাম তার নাম আমীর আহাম্মদ চৌধুরী, যাকে রতন দা নামে ছেলে বুড়ো সবাই জানে। ময়মনসিংহ জনপদে যদি শতবর্ষে একজন কিংবদন্তির নাম উচ্চারণ করতে হয়, তিনিই আমীর আহাম্মদ চৌধুরী রতন। সবার স্বজন রতন দা। আমি নিজের এবং সবার স্মরণের জন্য একটি গীতিকবিতার প্রথম দুটি পঙ্ক্তি উচ্চারণ করতে চাই সুখ বলে ওঠো সারি ঘুমাইও না আর এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার। (চলচ্চিত্র : গল্প হলেও সত্যি। গীতিকার : শ্যামল গুপ্ত) যারা সংশপ্তক, তাদের যেন ‘ওয়ানটাইম’র অবহেলা দিয়ে নিজেকে এবং আগামীর মানুষকে বঞ্চিত না করি। ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও লেখক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App