×

মুক্তচিন্তা

হালফিল রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ-শঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২০, ০৬:৪২ পিএম

একটি দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো সেদেশের রাজনীতি। রাজনীতি স্বচ্ছ-সুন্দর না হলে কোনো দেশই সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ হতে পারে না। রাজনীতি মানুষের সব রকম সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একটি রাজনৈতিক দল যখন মানুষের কাছে ভোট চায়, তখন সে দল সেবার বাণী মুখে নিয়েই ভোটারের দ্বারে বিনত ভঙ্গিতে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ সেবার একটি যোগসূত্র রাজনীতির সঙ্গে আছে বলেই বিশ্বে এখনো ‘রাজনীতি’ টিকে আছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া রাজনীতি বিকশিত হতে পারে না। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে মনে হয় এদেশে রাজনীতির আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। জেনারেল জিয়াউর রহমানের দুঃশাসন আমলে বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনীতিবিদরা সীমাহীন অন্যায়, অত্যাচার আর জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরই নয়, অসংখ্য সামরিক অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন জিয়া। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবেশ বিনষ্ট করে হত্যা, খুন আর ষড়যন্ত্রের যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন, তারই পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করেন স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদ। এরশাদের আমলে অর্থ, অস্ত্র আর মাদক-রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার রূপে দেখা দেয়। এ সময় নীতি-আদর্শের চেয়ে পেশিশক্তি অধিক কদর পেতে থাকে বাংলাদেশের ‘রাজনীতিতে’। ‘দশটা হোন্ডা বিশটা গুণ্ডা আর নির্বাচন ঠাণ্ডা’ এই অগণতান্ত্রিক ভোট ছিনতাই পদ্ধতি এরশাদের আমলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। এরশাদের মর্মান্তিক পতনের পর আসেন জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া। তিনি এসে স্বামীর দেখানো পথেই হাঁটেন। বাংলাদেশবিরোধী মৌলবাদীচক্র খালেদা জিয়ার ঘাড়ে চড়ে বসে। এর ফলে একদিকে দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে চলে লাগামহীন দুর্নীতি। খালেদা জিয়ার পুত্রদ্বয়, দলীয় নেতাকর্মী ও ভাড়াটে ঘাতকরা বাংলাদেশে যা ইচ্ছে তা-ই করতে থাকে। এদেশে তখন আইন-কানুন বলে আসলেই কিছু ছিল না। ক্ষমতা আর কালো টাকার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল পুরো সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এমনকি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীসহ অনেক বাহিনীর লোকজনই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। অবশ্য সেই ধারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো বলবৎ আছে। আজকের বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করেন তাদের শতকরা ৯৫ জনই ব্যবসায়ী। অর্থাৎ টাকাওয়ালা মানুষ। যারা টাকা ভালোবাসে তাদের পক্ষে কখনোই মানুষকে সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। এরা সেবা দিলেও এদের সেবার পেছনে টাকা উপার্জনের প্রবল লোভ থাকে। আজ আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে যদি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কমিয়ে সত্যিকারের রাজনীতিবিদের হাতে রাজনীতি তুলে দেয়া না যায়, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। আজকের রাজনৈতিক মাঠে নগদ অর্থ ছাড়া কেউই টিকতে পারবে না। একজন মানুষ যখন টাকা খরচ করে নির্বাচিত হয় তখন কি সত্যিকার অর্থেই তার পক্ষে সেবা দেয়া সম্ভব? চাকরিতে ঘুষের মাধ্যমে নিয়োগ পেলে ওই ঘুষ দেয়া চাকরিজীবী সারাক্ষণ ঘুষ নিয়েই চিন্তাভাবনা করে সেবা দেয় না। তদ্রুপ নির্বাচনে অঢেল টাকা খরচ করে ভোটে জয়ী হয়ে সেও অঢেল টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। আজকের বাংলাদেশে সংসদের দিকে তাকালে আমরা অসংখ্য দক্ষ ব্যবসায়ী দেখি বটে, কিন্তু দক্ষ কোনো সংসদ সদস্য দেখি না, দেখি না এমন কোনো আইনপ্রণেতা যাদের মুখের দিকে তাকিয়ে এদেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধতে পারে। বাংলাদেশে এখন মূলধারার যেসব রাজনৈতিক দল আছে, সেসবের ভেতরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলীয় কার্যক্রম চলে বলে মনে হয় না। আজ আমরা প্রত্যেকটি দলের মধ্যেই নানাবিধ সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। বড় বড় দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে যেসব নেতা পরবর্তী সময়ে দল গঠন করেছেন, আজ তারা প্রত্যেকেই ‘ওয়ান ম্যান পার্টি’তে পরিণত হয়েছেন। এসব দলে কর্মী নেই, ভোটার নেই, এমনকি সমর্থক আছে কিনা তাও সন্দেহ। এসব কোমর ভাঙা দলের দলীয় প্রধানরা যখন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, হুমকি-ধামকি দেন, তখন তা বড়ই হাস্যকর মনে হয়। এরা শুধু বাণী দেন আর সেমিনারে নিজেদের ছবি দেন। বামপ্রগতিশীল রাজনীতি যারা করেন, তারাও এদেশে একসঙ্গে থাকতে পারেন না। তারা দুজন একত্র হলে দুই দলের নেতা হয়ে বসেন। অর্থাৎ যত নেতা তত দল এই হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও বাম রাজনীতির চিত্র। এই ভগ্নদশা থেকে আমাদের পরিত্রাণ দরকার। অর্থ, লোভ আর দুর্নীতি রাজনৈতিক দলগুলোকে গ্রাস করে ফেলেছে। টাকার মোহে যারা রাজনীতির মাঠে নামে তারা হয়তো টাকা বানাতে পারে কিন্তু রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। এখনো রাজনীতি নিয়েই লেখাপড়া-গবেষণা করি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৯৬ সালে কেন আমরা আওয়ামী লীগের মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাহারা খাতুন, মোজাফফর হোসেন পল্টুর মতো ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে হাজী সেলিম, রহমতউল্লাহ, সাবের হোসেন চৌধুরীকে প্রার্থী করেছিলাম। আমরা তখন বুঝেছিলাম ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শুধু ভালো প্রার্থী দিলেই হবে না টাকাও খরচ করতে হবে। কেননা সেসময় যারা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল, তারা বাংলাদেশের ভোটের সংস্কৃতিই বদলে ফেলেছিল। এখন আবার সময় এসেছে সুস্থধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনার। আমাদের এখন সে পথেই হাঁটতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে টানা ১২ বছর ধরে বাংলাদেশ শাসন করছে। এই ১২ বছরে বাংলাদেশে অনেক কিছু বদলেছে। অনেক কিছুতেই বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে, কিন্তু একটি বিষয় আমাকে খুব ভাবিয়ে তোলে, সেটা হলো এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মতোই আরেকটি শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। যে দলে একজনও রাজাকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী থাকবে না, যে দল কখনোই বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না, আওয়ামী লীগ যেভাবে দেশ পরিচালনা করছে সেটা একেবারে মন্দ নয়, তবে মাঠে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে আওয়ামী লীগ আরো কাজ করে দেখাতে পারত বলেই মনে করি। আজ আমাদের ভাবতে হবে, একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সেই দলে স্থবিরতা নেমে আসে, এমনকি নানা কারণে সেই দল ভাঙনের মুখে পড়ে। তাই ভাঙন থেকে আওয়ামী লীগকে টিকে থাকতে হলে বিরোধী দল গঠনে সুযোগ করে দিতে হবে। আজ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ভারতের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, সিপিআই (এম), তৃণমূল কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা মানুষের চিরকাল থাকে না, ক্ষমতা হাতে থাকা অবস্থায়ই আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশকে একটি উন্নত জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। শুধু নিজেদের আখের গোছালে হবে না, আওয়ামী লীগে যেসব সুবিধাভোগী, হাইব্রিড নেতাকর্মী আছে, যারা টাকা দিয়ে অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে এদের বিরুদ্ধে এখনি কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেননি, তবু তিনি বাঁচতে পারেননি। আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রধান শেখ হাসিনাকেও এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও কঠোর হয়েছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কাউকেই তিনি ছাড় দিবেন না। এই মনোভাব বজায় থাকলে অচিরেই বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে। তবে এটাও ঠিক, দুর্নীতি দমন একা শুধু সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, যদি সেখানে জনগণ সচেতনভাবে সাড়া না দেন। আজ আমাদের সবাইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে এবং দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। আজকের বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করছেন তাদের বুঝতে হবে, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে এ দেশের মানুষের পালস বুঝতে হবে, বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে থেকে, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে, অন্য কোনো দেশের স্বপ্ন এ দেশে বাস্তবায়ন করতে চাইলে সেটা হবে বোকামি। আধুনিক বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে আধুনিক চিন্তা-চেতনা লালন করা দরকার। দুর্নীতিবাজদের পরিহার করে, ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরে রেখে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে বাংলাদেশে রাজনীতি করা দরকার। তা না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাবে। মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক ও কলাম লেখক;মহাপরিচালক; বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App