×

মুক্তচিন্তা

অদ্ভুত আঁধার এক নেমে আসছে বাংলাদেশে!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২০, ০৬:৪৮ পিএম

অদ্ভুত আঁধার এক নেমে আসছে বাংলাদেশে!
প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এ কোথায় চলেছি আমরা? একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে-না রাষ্ট্র-না দেশের বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সচেতন দায়িত্বশীল মানুষরা এই আমরা এই ঘৃণ্য অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষায় মিছিলে মিছিলে স্লোগানে স্লোগানে দেশটাকে উচ্চকিত করে তুলছি না? দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রয়োজনে আরেক দফা জীবনদানের প্রত্যয় নিয়ে একাত্তর বা ঊনসত্তরের মতো আর একটা ঝড় তুলছি না? লালমনিরহাটে এই মাত্র সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে একজনকে মসজিদের অভ্যন্তর থেকে ধরে এনে আঘাতে আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত করে রাস্তায় নিয়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে আগুন দিয়ে তার দেহ নৃশংসভাবে পুড়িয়ে দেয়া হলো। একজনও ছুটে গেলেন না ওই আদম সন্তানটিকে বাঁচাতে বা আইনের আশ্রয় নিতে। তার অপরাধ তারা দুই-তিনজন মিলে মসজিদে ঢুকে একটি রুমে কোনো একটা কিছু খোঁজাখুঁজি করছিল। তাদের (সম্ভবত মসজিদের ইমাম) জিজ্ঞেস করা হলো ‘কী কর?’ তারা বলল এখানে অবৈধ অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে খবর পেয়েছি, তাই খুঁজছি। সঙ্গে সঙ্গে কুরআন অবমাননার অভিযোগ আনা হলো। এই অপরাধের শাস্তি আগুনে পুড়িয়ে মারা? দেশের আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা জানালো হলো? স্পষ্ট করে বলি এটা বর্বরতা এবং এটা ইঙ্গিত দেয় যে আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছি এবং সে যুগের অসভ্যতা ও বর্বরতাকেই ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার একমাত্র মাধ্যম বলে ধরে নিয়েছি। হয়তো এ ব্যাপারে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে কিন্তু তেমন কোনো খবর এখনো কোনো পত্রিকায় চোখে পড়েনি। তবে সর্বশেষ জানা গেল রংপুরজুড়ে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে এই হত্যালীলার বিরুদ্ধে। একটা তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে। কিন্তু নিহতের পরিবার দাবি করছে বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্ত। পার্বতীপুরের দীপ্তি রানী দাস পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের বিবরণে জানলাম, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে দীপ্তি রানী দাস (১৭) নামের এক কলেজছাত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পার্বতীপুর রেলওয়ে থানার পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার সকালে গ্রেপ্তারকৃত দীপ্তি রানী দাসকে আদালতে পাঠানো হয়। জানা গেছে, পার্বতীপুর উপজেলা শহরের মোজাফ্ফরগঞ্জ মহল্লার অধিবাসী হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার দাস ও অনিকা দাসের কন্যা কলেজছাত্রী দীপ্তি রানী দাস ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত হেনে কুরআন শরিফ অবমাননা করায় স্থানীয় ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানরা বুধবার রাতে পার্বতীপুর শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বতীপুর মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ বাদী হয়ে পার্বতীপুর মডেল থানায় একটি মোকদ্দমা দায়ের করেন। ঘটনা আঁচ করতে পেরে বুধবার রাতে দীপ্তি রানী দাস ছদ্মবেশে নীল সাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে পালিয়ে ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পার্বতীপুর রেলওয়ে থানার ট্রেনের একটি বগি থেকে গ্রেপ্তার করে। একই দিন রাতে রেলওয়ে থানা পুলিশ গ্রেপ্তারকৃত দীপ্তি রানী দাসকে পার্বতীপুর মডেল থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। সাদামাঠাভাবে দেখলে কেউ একজন কুরআনের অবমাননা করে ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত করায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা এবং ‘অপরাধী’ দীপ্তি রানী দাসকে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানরা এবং পার্বতীপুর মডেল থানা ও পার্বতীপুর রেলওয়ে থানার পুলিশ মিলে ইসলামের মর্যাদা রক্ষায় যথার্থ কাজই করেছেন বলে মনে হবে। সাদা চোখে ভাবলে বিষয়টি নিয়ে দীপ্তি রানীর বিরুদ্ধে ঠিক কাজই করা হয়েছে এটাও মনে হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ওই ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানরা যে পার্বতীপুর শহরে রাতের বেলায় মিছিল করলেন তারা কি কেউ ফেসবুক দেখেছেন? না কি কোনো প্রচারণা শুনেই মিছিল বের করেছিলেন? পার্বতীপুর থানার কর্তব্যপরায়ণ ও অতি উৎসাহী এসআই শহীদুল ইসলাম নিজে বাদী হয়ে দীপ্তি রানীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিন-তিনটি ধারায় মোকদ্দমা দায়ের করেছেন। শহীদুল ইসলাম মিছিলকারীদের ব্যাপারে চুপ করে থেকে দীপ্তি রানীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেন, কিন্তু তিনি কি যাচাই করে দেখেছেন দীপ্তি রানী সত্য সত্যই কুরআন বা ইসলামের অবমাননা করে কোনো পোস্ট দিয়েছিল কিনা বা অসৎ উদ্দেশ্যে মেয়েটাকে বিপদে ফেলার উদ্দেশ্যে কেউ এমন প্রচার চালিয়েছে কিনা বা যদি কোনো পোস্ট থেকেও থাকে তবে তা সত্যিই দীপ্তি রানীর করা কিনা? মিছিল, মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার সব মাত্র দেড়-দুই ঘণ্টার মধ্যে রাতের বেলায় সম্পন্ন হয়ে গেল। হয় কি তাই চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে? ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে, নারী ধর্ষকদের বিরুদ্ধে, মজুতদারদের বিরুদ্ধে? পার্বতীপুর থানার যতগুলো মামলা তদন্তাধীন আছে, তার সব আসামি বা সন্দেহভাজন অপরাধীদেরও কি একইভাবে এবং সমান তৎপরতা দেখিয়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং সর্বদা তাই হয়ে থাকে? ওই ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা’ কেউ গিয়ে থানায় মামলা দায়ের করল না দেখেই কি অতি উৎসাহী হয়ে ওই থানার এসআই সাহেব দ্রুততার সঙ্গে নিজেই বাদী হয়ে তৎক্ষণাৎ মোকদ্দমাটি দায়ের করলেন? এই ঘটনার মাত্র দুই দিন পরে অনুরূপ আরো দুই-তিনটি ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেল। সর্বত্রই ইসলাম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার। ফ্রান্সের ঘটনা ফরাসি দেশের পণ্য বর্জন করে লাখো মানুষের মিছিল হলো মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে। সে দেশের সরকার হজরত মুহম্মদকে (সা.) অবমাননা করে এমন কার্টুন ছাপা হওয়ায় ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে এই অভিযোগে। আর সে দেশের ‘ধর্মপ্রাণ’ কতিপয় মুসলমান সেই দেশের নিশা নামক শহরে তিনজন ফরাসি নাগরিককে অতর্কিতে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে প্রতিশোধমূলকভাবে। কেন? ইসলাম ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করতে? এই খুনের প্রতিবাদে ফ্রান্সে ধর্মপ্রাণদের কোনো মিছিল বা প্রতিবাদ নেই। যারা খুন করলেন তারা বা বিক্ষুব্ধ ফরাসি মুসলিমরা। তারা সে দেশের আদালতে ইসলাম অবমাননার দায়ে সরকারের বা কার্টুন শিল্পীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা কি দায়ের করেছেন? না করে থাকলে কেন করেননি? তা না করে আইন হাতে তুলে নিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা কি আইনসম্মত? বা ইসলামসম্মত? তেমনি ফরাসি পণ্য বর্জনের দাবিতে যে পৃথিবীর বৃহত্তম মিছিল ঢাকার বুকে মুসল্লিরা করলেন, তারা কি কদাপি ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, নারী ধর্ষকদের বিরুদ্ধে, বিদেশে গোপনে টাকা পাচারকারীদের বা অসৎ মুনাফাখোর মজুতদারদের বিরুদ্ধে, সৌদি আরবে অসংখ্য বাঙালি মুসলিম নারীকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো প্রতিবাদ মিছিল বা সমাবেশ করেন? নাকি ইসলাম ওই কাজগুলো আদৌ অনুমোদন করে? ধর্ম কি শুধুই ইসলাম? আমাদের সংবিধান কি তাই বলে? লালমনিরহাট ও পার্বতীপুরের ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমান ও পুলিশ কর্মকর্তারা কি তেমনটাই মনে করেন? মন্দির, গির্জা, প্রতিমা ভাঙলে ও পুড়িয়ে দিলে তার বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণরা মিছিল করেন কি? থানার পুলিশ কর্মকর্তারা ওই অভিযোগে কোনো মামলা কারো বিরুদ্ধে দায়ের করেন কি? কাউকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠান কি? ঢাকার মুসল্লিরা লাখে না হোক, হাজারে হাজারে মিছিল-সমাবেশ করেন কি মন্দির, গির্জা, প্রতিমা ভাঙচুর বা সেগুলোতে অগ্নিসংযোগের বিরুদ্ধে? না কি তাদের বিবেচনায় ওই কাজগুলো ইসলামসম্মত? বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সংস্কৃতিকর্মীরা, ছাত্র-যুব ও অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীকেও কদাপি এগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না। তাই বলি অদ্ভুত আঁধার এক নেমে আসছে বাংলাদেশে। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App