×

সাহিত্য

একাধিকবার তালিকা নেয়া হলেও সাড়া পাননি ভোলার শিল্পীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪৮ এএম

একাধিকবার তালিকা নেয়া হলেও  সাড়া পাননি ভোলার শিল্পীরা

করোনার থাবায় এখনো স্থবির সংস্কৃতিপাড়া। আয়োজন নেই এমন নৃত্যানুষ্ঠানের -ফাইল ছবি

স্থবির জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড -৩৫

দেশের বৃহত্তম প্রাচীন গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ ভোলা। এ জেলার নামকরণের পেছনে স্থায়ীভাবে একটি লোককাহিনী প্রচলিত আছে। ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতুয়া নামক খালটি এখনকার মতো অপ্রশস্ত ছিল না। এক সময় এটি বেতুয়া নদী নামে পরিচিত ছিল। বুড়ো এক মাঝি খেয়া নৌকার সহায়তায় নদীতে মানুষ পারাপারের কাজ করতেন। তার নাম ছিল ভোলা গাজি পাটনি। বর্তমানে যোগীর ঘোলের কাছেই ছিল তার বসতি। এই ভোলা গাজির নামানুসারেই এক সময় স্থানটির নামকরণ হয় ‘ভোলা’। শিল্প সংস্কৃতিতেও বেশ প্রাচীন এই জেলা।

ভোলার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরা ছিল পর্তুগিজ দস্যুদের দখলে। পরে এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন বসতি স্থাপন করে। এ ছাড়া চর কুকরি মুকরি, ঢাল চর, দেউলি, মনপুরা ফিশারিজ লিমিটেড, মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশন, খেয়াঘাট সেতু, বক ফোয়ারা, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, খেয়াঘাট, শাহবাজপুর মেঘনা ট্যুরিস্ট স্পট দেখার মতো। কিন্তু জমিদার অঞ্চল আর গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ ভোলাকেও করোনা আঘাত হেনেছে। যে আঘাতে এর অন্য অঙ্গনের মতো শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গনও স্থবির করে দিয়েছে।

সূত্র জানায়, ভোলায় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ৬০টি। সংস্কৃতি কর্মীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় এক হাজারের মতো। তাদের অনেকে সংস্কৃতিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে। যারা সরকারি-বেসরকারি নানা অনুষ্ঠান করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে গেছে। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে তালিকা নেয়া হলেও কেবল শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে ৫০ জনকে অনুদান দেয়া হয়েছে। বাকি অনেকের জীবন কাটছে কষ্টে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ শিল্পীই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অথচ শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসারের পক্ষ থেকে একাধিকবার তালিকা এবং বিকাশ নম্বর নেয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। অনন্যেপায় হয়ে কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। কেউ কেউ ধার দেনা এবং জমানো টাকা ভেঙে চলছেন। করোনাকালে শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা না দিলেও অন্তত ভিজিবি কার্ড কিংবা রেশন কার্ড দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।

জানতে চাইলে ভোলা চরফ্যাশন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জসিম উদ্দিন টিপু ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার আঘাতে শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে যারা সংস্কৃতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। তাদের মধ্য থেকে ৬০ জনকে উপজেলা প্রশাসন এবং সংসদ সদস্যের কাছ থেকে চাল, ডাল, তেল নিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে একাধিকবার তালিকা এবং বিকাশ নম্বর নেয়া হলেও কোনো সাড়া পাইনি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সংস্কৃতি জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। করোনা পরিস্থিতিতে শিল্পীদের বিলীন হয়ে যাওয়ার রাস্তাটা খুলে গেল!

জোটের এই নেতা আরো বলেন, সরকার কোনো সহায়তাই যখন দিচ্ছে না, তাহলে খাদের কিনারে চলে যাওয়া এসব শিল্পীদের ভিজিবি কার্ড কিংবা রেশন কার্ড দেয়া হোক। এটা আহ্বান নয়, আমাদের দাবি।

অক্টোপেড ও তবলা শিল্পী সাগর মালাকার বলেন, যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, তখন আমাদের কদর ছিল। আজ আমরা নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি, তখন কেউ খোঁজও নিচ্ছে না। ভাবছি এই পেশায় আর থাকব না। এই লাইনে থেকে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ভাবছি কয়েকজনে মিলে ফ্লেক্সি লোডের ব্যবসা করব। এ অঙ্গনের দিকে সরকার কতটা নজর দিচ্ছে জানি না। নাকি কেবল জেলারই খোঁজই নিচ্ছে! এদিকে আসতে আসতে সরকারি সহায়তা শেষ হয়ে যাচ্ছে! গত চার মাস আগে তালিকায় নাম দিয়েছিলাম। কিন্তু সহায়তার জন্য আমাদের খোঁজই নেয়া হলো না!

এই শিল্পী বলেন, আমরা শিল্পীরা যদি না খেয়েও থাকি কারো কাছে বলতে আত্মসম্মানে লাগে। তাই এতদিন জমানো টাকাই ভেঙে চলেছি। এখন এমন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছি, এটা যে আমার পেশা তা বলতেও পারছি না!

শ্রাবণী খেলাঘরের যুগ্ম সম্পাদক সরণ মজুমদার বলেন, করোনা একেবারে বেকার করে দিয়েছে আমাদের এলাকার পেশাজীবী শিল্পীদের। অনেককে এমপি সাহেবের কাছ থেকে এবং এর ওর কাছ থেকে অনেক চাপাচাপি করে কয়েকজনকে সহায়তা নিয়ে দিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে ৩ থেকে ৪ বার তালিকা নেয়া হলেও কোনো সাড়া শব্দ পাইনি। অথচ যাদের পকেট ভরা তারাই পাচ্ছে। যাদের পকেট শূন্য তারা শূন্যই রয়ে যাচ্ছে। আমাদের দাবি যাচাই-বাছাই করেই যেসব শিল্পী এই পেশার ওপরই নির্ভরশীল তাদেরই সহায়তা দেয়া হোক।

বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ ভোলার নির্বাহী সদস্য ও জীবন পূরাণ আবৃত্তি একাডেমির পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, শিশু একাডেমিসহ কয়েকটা আবৃত্তি সংগঠনে আমি পেশাগতভাবে প্রশিক্ষক। সবই বন্ধ হওয়ায় আমার পরিস্থিতি খারাপ। শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ করছে। কিন্তু আমি সাহস পাচ্ছি না।

সংগীত প্রশিক্ষক মনজুর আহমেদ বলেন, ৫০ বছর ধরেই এ পেশায় আছি। গানই আমার পেশা এবং গানই আমার নেশা। কিন্তু করোনার কারণে সবই জীবন জীবিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে গেছি। সম্প্রতি করোনাকালেই আমার মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছে। এর কারণে চোখেও দেখতে পাচ্ছি না।

করোনায় বেকার হয়ে যাওয়া শিল্পীদের সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, শিল্পীরা তো কারো কাছে হাত পেতে চাইতে পারে না। তাই তাদের দিকে নজর দিতে হবে দায়িত্ব নিয়ে। নইলে সাংস্কৃতিক অঙ্গন শূন্য হয়ে যাবে।

বিহঙ্গ সাহিত্যগোষ্ঠীর পরিচালক ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক অমিতাভ অপু বলেন, যারা সংস্কৃতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তাদের কোথাও যাওয়ার সুযোগই নেই। তারা কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। যৎসামান্য সহায়তা দেয়া হয়েছে তা উপকারেই আসে না। এটা বাড়ানো উচিত।

বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক বাঁধন তালুকদার বলেন, যে মানুষগুলো পেশাদার শিল্পী হিসেবে পরিচিত তারা এখন নাই বললেই চলে। শিল্পীরা হাত তালি পেয়ে এখন বিপদে পড়ে হাত পাততে লজ্জা আর অপমান বোধ করছে। এদের কেউ কেউ পেশা বদলেও ফেলেছে।

জানতে চাইলে ভোলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার তানভির রহমান ভোরের কাগজকে বললেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ৭৫ জনের, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে ৫০ জনের এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে ৫০ জনের তালিকা নিয়েছি। তবে এখনো সেসব খাত থেকে সহায়তা এখনো আসেনি। তবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ৫০ জন শিল্পীর জন্য ৫০০০ হাজার টাকা করে আড়াই লাখ টাকার সহায়তা পাঠিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App