×

সাময়িকী

স্মৃতিতে আবুল হাসনাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৩৬ পিএম

স্মৃতিতে আবুল হাসনাত

আমার পরিচিতজনের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র, মার্জিত, অমায়িক এবং স্বল্পবাক মানুষ ছিলেন আবুল হাসনাত। তিনি পয়লা নভেম্বর ’২০ তারিখে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। প্রথমে সংবাদটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কেননা, বয়সের দিক থেকে আমার আগে যাবার কথা ছিল। কিন্তু হাসনাত নিয়ম ভঙ্গ করলেন। আরো কয়েক বছর বেঁচে থাকলে তিনি আমার মতো পৃথিবীর আলো বাতাস ভোগ করতে পারতেন। সেটি আর হলো না। হাসনাতের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। আমি তখন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করি। আমার বস খ্যাতনামা লোকসাহিত্য বিশারদ শামসুজ্জামান খান। তখন তিনি এ খ্যাতি অর্জন করেননি। হাসনাত প্রায়ই তার কক্ষে আসতেন, সঙ্গে অনেক সময় কমরেড অজয় রায়ও আসতেন। তার সঙ্গে গল্প করতেন। শামসুজ্জামান খান হাসনাতের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, হাসনাতের কিন্তু আরেকটি নাম আছে, মাহমুদ আল জামান। এই নামে তিনি কবিতা লেখেন। গল্প, প্রবন্ধ লেখেন আবুল হাসনাত নামে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকে দেখলাম কেননা, মাহমুদ আল জামানের অনেক কবিতা পড়েছি। কিন্তু কবিকে কখনো দেখিনি। হাসনাতকে দূর থেকে অনেক দেখেছি। হাসনাত দেখতে হালকা পাতলা গড়ন। রঙিন আজানুলম্বিত পাঞ্জাবি, দেখতে অনেকটা নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমদের মতো। মমতাজ ভাই রসিক লোক, কৌতুকপ্রিয়। কিন্তু পরে হাসনাতকে দেখেছি, তার বিপরীত, গুরুগম্ভীর। মাথায় লম্বা চুল, পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ধীরগতিতে হাঁটেন- মাথা নিচু করে। দেখে মনে হয় রাজ্যের দুশ্চিন্তা তার মাথায়। চলার সময় ডানে বাঁয়ে তাকান না। দেখা হলে হাসনাত এমনভাবে তাকাতেন, মনে হয় এই প্রথম দেখলেন।

আমি হাসনাতকে বললাম, আমি আপনার অনেক কবিতা পড়েছি। ভালো লেগেছে। কিন্তু কবিকে চিনতে পারিনি। আজ পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। হাসনাত বললেন, আমিও আপনার লেখা পড়েছি। ষাট, বাষট্টি সালে আপনার লেখা সংবাদের সাহিত্যের পাতায় ছাপা হতো। আমি বললাম, মাত্র তিনটি গল্প সে সময় আমার ছাপা হয়েছিল। কবি হাসান হাফিজুর রহমান সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন জগন্নাথ কলেজে। আমার মেজো ভাই গোলাম মোস্তফা সেলিম আর তার বন্ধু সলিমুল্লাহ্ তার বাসার নিচতলায় ভাড়া থাকতেন। আমার ভাই সিএ পড়তেন, সলিম ভাই সংবাদ-এর রিপোর্টার ছিলেন। হাসান ভাইয়ের বাসা কাজী আলাউদ্দিন রোডে। মাঝেমধ্যে আমি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। সেখানে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র। হাসান ভাই একদিন হঠাৎ আমাকে বললেন, তুমি গল্প লেখ না কেন? হাসান ভাই খুব দ্রুত কথা বলতেন। আমি তার কথা বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, বাংলায় পড়ো, গল্প কবিতা লিখ? আমি বললাম, লিখি। তিনি বললেন, তাহলে আগামীকাল আমাকে একটা গল্প দেবে। পরপর আমার তিনটি গল্প সংবাদে ছাপা হলো। হাসনাত বললেন, এখন লেখেন না কেন? বললাম, আমার ভাই হাসান ভাইয়ের বাসা ছেড়ে যাবার ফলে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। হাসনাত বললেন, আবার লিখতে শুরু করেন। আপনার গল্প আমি ছাপবো। শামসুজ্জামান, হাসনাত আর আমি জামান সাহেবের কক্ষে প্রায় গল্প করি, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করি। হাসনাত কথা বলেন কম, শোনেন বেশি। যখন কথা বলেন, অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন। প্রত্যয়ের সাথে বলেন। দৃঢ়তা তার অভিব্যক্তিত্বে ফুটে উঠতো। হাসনাতের মুখে সব সময় মৃদু হাসি লেগে থাকতো। বিশেষ করে কারো সাথে পরিচয়ের সময়। তাকে উচ্চস্বরে কখনো হাসতে দেখিনি। জেনারেল এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর বাংলা একাডেমির নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত আমলা মহাপরিচালকের পরামর্শে আমাকেসহ একাডেমির দশজন কর্মকর্তাকে বাংলা একাডেমি থেকে বিতাড়িত করে অন্যত্র নিয়োগ দেয়া হয়। আমার পদায়ন হয় বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে। বিতাড়িতদের মধ্যে আমার সাথে ছিলেন কথাসাহিত্যিক আবুল হাসনাত এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত শামসুল হক ও আল কামাল আবদুল ওহাবসহ আরো কয়েকজন। একদিন আবুল হাসনাত আমার নতুন কর্মস্থল শিশু একাডেমিতে আসেন। আমার সাথে গল্প করেন। সঙ্গে থাকতো আমার সহকর্মী সাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়–য়া ও সুজন বড়–য়া এবং রহিম শাহ্। আমি হাসনাতকে তার পত্রিকায় ছাপার জন্য ‘একটি নিয়োগপত্র’ নামে একটি গল্প দিই। গল্পের সারসংক্ষেপ : ‘একটি শিক্ষিত বেকার যুবক চাকুরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন অফিসে ইন্টারভিউ দেয়। অবশেষে একটি ব্যাংক থেকে একটি নিয়োগপত্র পায়। নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে যুবকটি কর্মস্থলে যোগদান করতে গেলে ম্যানেজার তাকে যোগদান করতে দেয় না। বলে, দেশে সামরিক সরকার এসেছে। ফরমান জারি করেছে, সরকারি নতুন নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কোনো নতুন লোক নেয়া যাবে না। যুবকটি বললো, আমিতো নতুন সরকার আসার আগেই নিয়োগপত্র পেয়েছি। আমার যোগদানে বাধা কোথায়। অবশেষে তার চাকুরি হলো না।’ আমি একদিন হাসনাতকে গল্পটি দিলাম। হাসনাত সপ্তাহখানেক পরে আমাকে ফোন করে জানালো, আপনার গল্প ছাপানো যাবে না। সেলুফিন পর্যন্ত তোলা হয়েছিল। আমি বললাম, আমার গল্পে তো সরকারবিরোধী কোনো বক্তব্য ছিল না। হাসনাত বললো, ইঙ্গিতেও বলা যাবে না। আমার গল্প ছাপা হলো না। এরপর থেকে আমি আর গল্প লিখি না। একদিন হাসনাত বললেন, আরেকটা গল্প দিন। আমি বললাম, আমার ভেতর থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমি গল্প লিখবো না। আবুল হাসনাত কবিতা ছাড়া গদ্যও ভালো লেখেন। বিশেষ করে, শিশুতোষ সাহিত্য। তার রচিত ‘সমুদ্র ও টুকুর গল্প’ এবং ‘সূর্যসেনের জীবনী’ গ্রন্থ শিশু একাডেমি থেকে ছাপা হয়। ‘সমুদ্র ও টুকুর গল্প’ অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার লাভ করে। ইতোমধ্যে অনেক বছর কেটে গেছে। আমি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছি। হাসনাতের সঙ্গে আর দেখা হয় না। গত বছর এমন দিনে একটি গল্প নিয়ে ধানমন্ডিতে হাসনাতের ‘কালি ও কলম’ অফিসে যাই। হাসনাতের বয়স হয়েছে। চুলে পাক ধরেছে। চেহারায় আগের সেই মাধুর্য নেই। মুখে একটা বিরক্তির ছাপ- সম্ভবত অসুস্থতার কারণে। আমি হাসনাতের হাতে গল্পের পাণ্ডুলিপি দিলাম। খুব ছোট গল্প। নাম, ‘হেফাজতী হুজুরের তেঁতুল তত্ত্ব’। হাসনাত হাত বাড়িয়ে গল্পটি নিয়ে পড়লেন। বললেন, এ গল্প ছাপা যাবে না। আমরা বিতর্কিত কোনো লেখা ছাপি না। আমি কোনো মন্তব্য না করে গল্পটি নিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বাইরে এসে গল্পটি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কখনো গল্প লিখবো না। হাসনাতের উপর রাগ করলাম না। আমি তার অক্ষমত ও সীমাবদ্ধতার কথা জানি। কয়েক বছর আগে একটি উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ঢাকা শহরে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল তা দেশবাসীর স্মরণে আছে। দেশে এখন সামরিক সরকার নেই। দীর্ঘদিন যাবৎ একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার দেশ চালাচ্ছে। সরকারকে এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করতে হয়েছে। আমাদের সমাজে এবং রাষ্ট্রে এখনো এমন অপশক্তি বিরাজ করছে যাদের অস্বীকার করা যাবে না।

যাদের বিরুদ্ধাচরণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। দেশে আবার সামরিক সরকার আসুক বা না আসুক তাতে কিছু যায় আসে না। সামরিক সরকার এলে এই অপশক্তি বরং আরো শক্তিশালী হবে। এই অপশক্তির হাত থেকে দেশ কবে মুক্তি পাবে? আমাদের সম্পাদকরা কবে নাগরিকদের লেখা প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে? আবুল হাসনাত আর কখনো আমার কোনো লেখা ছাপার সুযোগ পাবেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App