×

সাময়িকী

সৌন্দর্যহীন গল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২০, ০৮:০৬ পিএম

সৌন্দর্যহীন গল্প

পেয়ারা গাছটায় নতুন পাতা গজিয়েছে, পাতাগুলো সবুজ তবে একটু ফিকে। উদয়নাথ মনোযোগ সহকারে কচি পাতাগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি স্থানীয় কলেজের বোটানির শিক্ষক। উদয়নাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। স্বাধীনতার পর তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। তার বড় ভাই শম্ভুনাথ তাকে দেখে ভয়ঙ্কর রেগে উঠলেন, তবে সেটা মনে মনে। এযাবৎকাল শম্ভুনাথ তার বাবার বিশাল সম্পত্তি ভোগ করে আসছেন, তার ধারণা ছিল ছোটভাই উদয়নাথ কলকাতায় স্থায়ী হবেন, আর তিনি হবেন বাবার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরসূরি। যা হোক তিনতলা বাড়ির একতলায় বৈঠকখানা করা হলো, দুতলা উদয়নাথের আর তিনতলা শম্ভুনাথের। দুই ভাইয়ের একই দিনে বিয়ে দেওয়া হলো। উদয়নাথের চারটি সন্তান- নীল, বর্ষণ, শরৎ, মেঘ। অপরদিকে শম্ভুনাথের এখন পর্যন্ত কোনো সন্তান হয়নি। উদয়নাথের সন্তানদের মধ্যে তিনটি ছেলে ও মেঘ হলো একমাত্র কন্যা সন্তান। চারটি সন্তানই খুব হাসিখুশি এবং যা করে একসাথে বুদ্ধি করে করে। মেঘের বয়স দশ আর ছেলেদের বয়স বারো, চৌদ্দ এবং ষোলো। উদয়নাথের ও তার স্ত্রীর মধ্যে খুব প্রেম। তিনি তার স্ত্রীর যত্ন করেন। এক একটা বাচ্চা পেটে আসার পর উদয়নাথ তার স্ত্রীকে কোনো কাজ করতে দেননি। একাই সব কাজ সামলাতেন। এনিয়ে কম হাসাহাসি হয়নি, তবুও উদয়নাথ অনড়। তার কথা স্ত্রীকে যদি ভালোবেসে থাকি তবে তাকে কেন কষ্ট করতে দেবো। বৈশাখ মাস, খুব গরম, চার ভাইবোন দোতলার দক্ষিণ দিকের কাঠের জানালা খুলে দিল। হঠাৎ মেঘ বলল, দেখ দাদা শিল্পী মাসি আর শম্ভু জ্যাঠা কেমন জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে! শম্ভুনাথ বরাবর চরিত্রহীন ও মদ্যপ। শিল্পী তার বউয়ের ছোট বোন। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্টভাবেই চার ভাইবোন তাদের অনৈতিক সম্পর্কের কিছু চিত্র দেখতে পেল। এরই মধ্যে ঘটে গেল অঘটন, ছোট ছেলে শরৎ ভুল করে একটা হাঁচি দিল, যার শব্দ চলে গেল শম্ভুনাথের কানে। তিনি উপরের দিকে তাকালেন যদিও তখন চার ভাইবোন সেখান থেকে হাওয়া। পরদিন খুব ভোরে, মেঘ যখন ফুলের ঝুড়িতে ফুল তুলছিল, শম্ভুনাথ পা টিপে টিপে তার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। মেঘ মাথা ঘুরিয়ে জ্যাঠাকে দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু না মেঘকে বলিষ্ঠ শম্ভুনাথ ধরে ফেললেন। হাত ধরেই, খুব জোরে হাতে একটা চাপ দিয়ে শম্ভুনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাতে তোরা জানালার ধারে কি করছিলি?’ মেঘ মিথ্যা বলতে জানে না। কারণ তার বাবা উদয়নাথ প্রতিদিন সকালে পড়াতে বসান আর বলেন, ‘কখনো মিথ্যা বলা যাবে না’ বাবার কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করে মেঘ। হঠাৎ করে মেঘকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উদয়নাথ পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার আদরের সাত রাজার ধন, বুকের মানিক মেঘকে। এরই মধ্যে শম্ভুনাথ একখানা মিথ্যা বাড়ির দলিল নিয়ে উদয়নাথের ঘরে হাজির হলো। উদয়নাথের স্ত্রী উন্মাদের মতো কাঁদছে তার কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে আসছে। তিন ছেলে গুটিসুটি মেরে ঘরের এক কোণে বসে আছে। নর্দমার কীট শম্ভুনাথ এদৃশ্য সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই বললেন, ‘তুমি যখন কলকাতার পড়াশোনা করতে তখনই বাবা এ বাড়ি আমার নামে লিখে দিয়েছেন। এ দলিল এতদিন যাবৎ বাবার আলমারিতে পড়েছিল, গতকাল বাবার আলমারি ঠিক করতে গিয়ে এটা আমার চোখে পড়লো!’ উদয়নাথ বললেন, ‘দাদা, এখন এগুলো বলার সময় নয়। দেখো মেঘকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ ছোট ভাইয়ের কথার গুরুত্ব না দিয়ে শম্ভুনাথ বললেন, ‘আমি কিছু শুনতে চাই না তুমি এখনই পরিবারসহ এ বাড়ি থেকে বের হও, তোমাকে অসহ্য লাগছে।’ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে শম্ভুনাথ প্রায় দশ বারো জন লোক নিয়ে উদয়নাথের ঘরের সমস্ত জিনিস টেনেহিঁচড়ে বের করতে লাগলেন। ভয়ে উদয়নাথ বাড়ির কাছে তার এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। সারা দিনরাত বিভিন্ন জায়গায় মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে, তিনি স্থানীয় থানায় বিষয়টি জানিয়ে জিডি করলেন। পরদিন সকাল বেলা বাড়ির কাছে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে মেঘের লাশ ভেসে থাকতে দেখা গেল। ছোট এ শহরের সব মানুষ পুকুরপাড়ে জড়ো হলো। পুলিশ যখন মেঘের লাশ উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথা থেকে পাগলের মতো এলোমেলো চুলে শম্ভুনাথের স্ত্রী দৌড় এসে পুলিশকে বললেন, ‘আমি সন্তানসম্ভাবা, আমার স্বামী আমাকে গত কয়েকদিন আগে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল, তার রান্নার কথা বলে আমার বোন শিল্পীকে নিয়ে আসে। আমার বোনের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেটি আমি বুঝতাম। গতকাল রাতে হঠাৎ করে আমি বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে আসি, এসে নিচতলার বৈঠকখানায় দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় মেঘকে দেখতে পাই। আমার স্বামী আরো দুজন লোককে সাথে নিয়ে মেঘকে বেঁধে লাঠি দিয়ে মারছিল। আমাকে দেখে তারা হতবাক হয়ে পড়ে, তখনই আমাকে বেঁধে রেখে আমার চোখের সামনেই শিশুটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।’ শম্ভুনাথ ও তার সঙ্গীদের ফাঁসি হয় কিন্তু উদয়নাথের মনের ক্ষত কোনোদিন শুকিয়ে যায়নি, তিনি পৃথিবীতে আর কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পায় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App